একদিন মাটির ভিতরে হবে ঘর : নিগার সুলতানা পপি

নিগার সুলতানা পপির গানে প্রথম হাতেখড়ি বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী বদরুন্নেসার মাধ্যমে। হরিমোহন দেবনাথ, একরাম উল্লাহ, শেখ জসিম- তাঁদের সান্নিধ্য পাওয়াও শিল্পীর জন্য সৌভাগ্য এনে দিয়েছিল। তিনি ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছেন এবং প্রতিযোগিতাগুলোতে প্রথম বা দ্বিতীয়ও হয়েছেন। এছাড়া তিনি উষসী পরিষদ ঢাকা ২০১৯ ঈদ তারকা অ্যাওয়াার্ড, সমতটের কাগজ গুণীজন সম্মাননা অ্যাওয়ার্ড, আন্তর্জাতিক বাউল উৎসব বাউল তরী ২০১৮ পুরস্কার, নব নান্দনিক কলকাতা সম্মাননা পুরস্কার ২০১৮, সুবল মেলা সম্মাননা পুরস্কার (কলকাতা), মানুষ মেলা সম্মাননা পুরষ্কার (কলকাতা), সারা বাংলা লালন মেলা পুরস্কার (কলকাতা), রানাঘাট উৎসব সম্মাননা পুরস্কার ২০১৭ অর্জন করেন। সম্প্রতি দৈনিক উন্নয়ন বার্তার পক্ষ থেকে নেয়া এই কণ্ঠশিল্পীর সাক্ষাতকারটি তুলে ধরা হলো :

উন্নয়ন বার্তা : গানের ভুবনে কি করে এলেন?
নিগার সুলতানা পপি : আমার বয়স যখন অল্প, যখন আমি খুব ছোট তখন থেকে আমার গানের জগতে আসা। আমার দাদী খুব গান পছন্দ করতেন এবং আমার ফ্যামিলির প্রত্যেকটি মানুষ গান খুব পছন্দ করতেন। তাদের অনুপ্রেরণায় উৎসাহে আমার গানের জগতে আসা।

উন্নয়ন বার্তা : আপনি সাধারণত কোন্ ধরনের গান গাইতে বেশি পছন্দ করেন?
নিগার সুলতানা পপি : আমি সাধারণত লালনগীতি এবং ফোক গান গাইতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি।

উন্নয়ন বার্তা : বিভিন্ন মিডিয়ায় আপনার উপস্থিতি সম্পর্কে বলুন।
নিগার সুলতানা পপি : আমি বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং বাংলাদেশ বেতারের লোকগীতি এবং আধুনিক দুই শাখাতেই এনলিস্টেড আর্টিস্ট। তাছাড়া বেসরকারি টেলিভিশনের ভিতর মাছরাঙ্গা, মোহনা টেলিভিশন, এনটিভি, বাংলাভিশন, এটিএন বাংলায় আমি নিয়মিত অনুষ্ঠান করছি। তাছাড়া আমাদের দেশের বাইরে কলকাতার তারা চ্যানেলে আমি নিয়মিত অনুষ্ঠান করি। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে গান গাওয়ার সুযোগও হয়েছে।

উন্নয়ন বার্তা : আপনার সঙ্গীত জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা সম্পর্কে আমাদের কিছু বলুন।
নিগার সুলতানা পপি : আমার উল্লেখযোগ্য ঘটনার ভিতরে আমি একটি ঘটনা আপনাদের সাথে শেয়ার করছি। আমি একবার কলকাতায় অনুষ্ঠান করতে গিয়েছিলাম। সেখানে স্টেজে আমার একটি গান করার কথা ছিল। আমি যখন গানটি গেয়ে নেমে গেলাম তখন দর্শকদের অনুরোধে আমাকে আবার স্টেজে উঠতে হলো গান করার জন্য এবং সেই গানটি আমাকে পরপর চারবার করতে হয়েছে। তো আমি আসলেই নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে করি এই কারণেই যে, দর্শকদের ভালো লাগার কারণ এই একই স্টেজে একই গান তারা পরপর চারবার আমার কাছ থেকে শুনেছে। সেই গানটি হলো- “একদিন মাটির ভিতরে হবে ঘর”।

উন্নয়ন বার্তা : সঙ্গীত নিয়ে আপনার বিশেষ কোন পরিকল্পনা থেকে থাকলে এ বিষয়ে কিছু বলুন।
নিগার সুলতানা পপি : আমাদের শেকড়ের গান, প্রাণের গান মাটির গান হচ্ছে লোকগীতি, পল্লীগীতি। আমাদের এই লোকগীতির বিশাল একটি ভান্ডার রয়েছে। আমার পরিকল্পনা বা প্রত্যাশা হচ্ছে এরকম- আমাদের এই গানগুলোকে যদি সরকারিভাবে উদ্যোগ নিয়ে দেশের আনাচে-কানাচে সব জায়গা থেকে একত্রিত করে যদি একটি আর্কাইভ করা হয় তাহলে আমরা যারা লোকগীতি করছি আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম লোকগান করবে তারা অনেক সুন্দর শুদ্ধ গানগুলোকে পাবে। তখনই গানগুলো আর বিকৃত হবে না। এককথায় একই সুরে আমরা সবাই একটি গান করতে পারবো।

উন্নয়ন বার্তা : আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, লোকজ সংস্কৃতি বিকাশে বর্তমান মিডিয়ার ভূমিকাকে আপনি কিভাবে দেখেন?
নিগার সুলতানা পপি : আমাদের লোকগীতি আমাদের প্রাণের গান শেকড়ের গান। আজকাল কিছু কিছু শিল্পীই গানগুলোকে ফিশনের নামে কনফিউশন তৈরি করছে এবং গানের সুরগুলো বিকৃত করছে কথাগুলোকে তারা চেঞ্জ করে ফেলছে। তো আমি ওদেরকে একটা অনুরোধ করবো সেটা হচ্ছে যে- আপনারা আসল গান, গীতিকার-সুরকার তাঁদের গানগুলোকে অনুসরণ করুন। প্রকৃত গানটি আপনারা করুন সুর এবং কথা ঠিক রেখে। তাই নিজেকে পরিবর্তন করুন কিন্তু গানটিকে নয়। এক্ষেত্রে মিডিয়া মূল গানগুলোকে অবিকৃত রাখতে ভূমিকা রাখবে এটা আমার প্রত্যাশা।

উন্নয়ন বার্তা : আমাদের গানের জগত বিশেষ করে লোকজ গানের জগত বর্তমানে মূলধারার গানের জগতে কি অবস্থানে রয়েছে?
নিগার সুলতানা পপি : সবাই যদি একত্রে হতে পারি, একটি ছাতার নিচে দাঁড়াতে পারি তাহলেই আমাদের এই মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি নিজস্ব শক্তিকে টিকে থাকবে মূলধারায় এবং আমরা এটাকে পেশা হিসেবে নিতে পারবো।

উন্নয়ন বার্তা : আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি বিকাশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কি কি পদক্ষেপ নেয়া দরকার বলে আপনি মনে করেন?
নিগার সুলতানা পপি : আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি বিকাশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নানা রকম পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। যেমন- বিভিন্ন জেলায় জেলায় গানের প্রতিযোগিতা করে শিল্পী বের করে নিয়ে আসা , সরকারি ও বেসরকারিভাবে বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় গানের স্কুল তৈরি করা, নতুন নতুন শিল্পীদের বিভিন্ন চ্যানেলে এবং রেডিওতে গানের সুযোগ করে দেওয়া। তাহলে সবাই গান করতে পারবে সুন্দর করে ভালো করে। দেশের বাইরে আমাদের এই লোকগীতিকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তুলে ধরা, এরকম আরও নানা রকম উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।

উন্নয়ন বার্তা : বাংলা গানের ওপর বিদেশি কুপ্রভাব রয়েছে- যাকে অনেকে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বলে অভিযোগ করে থাকেন। এ বিষয়ে আপনার মত কি?
নিগার সুলতানা পপি : আজকাল বাংলা গানের ওপর বিদেশি গানের একটু প্রভাব পড়েছে। অনেক মিউজিক ডিরেক্টর বিভিন্ন বিদেশি গানের সুর নকল করে মিউজিক নকল করে বাংলা গানের সাথে মিলিয়ে দিচ্ছে- এটা একেবারেই ঠিক নয়।

উন্নয়ন বার্তা : একসময়ে বাংলাদেশে দেশাত্মবোধক গান বেশ জনপ্রিয় ছিল। আমাদের বিখ্যাত শিল্পীদের প্রায় সবাই অন্য গানের পাশাপাশি দেশাত্মবোধক গানও গাইতেন। আবার অনেকে লোকগীতি, পল্লীগীতিও গাইতেন। কিন্তু এখনকার শিল্পীদের এই প্রবণতা তেমন একটা দেখা যায় না। বিষয়টি আপনি কিভাবে দেখেন?
নিগার সুলতানা পপি : গান হচ্ছে শিল্পীর ভালো লাগার বিষয়, চর্চার বিষয়। এখনকার সময় যারা গান করছেন তাদের প্রত্যেকের একটি নিজস্ব মতামত রয়েছে, ভালোলাগা রয়েছে, পছন্দের জায়গা রয়েছে। তাই যেই শিল্পী যেই বিভাগে পারদর্শী হয়তোবা তিনি সেই গানটি এখন করছেন। আর এখনকার শিল্পীরা চর্চা করছেন তারা রাতারাতি স্টার হতে চান। যে কারণে হয়তোবা তারা এখন একটি বিভাগের বাইরে আর অনুরাগে গান করতে চান না।

উন্নয়ন বার্তা : এখনকার তরুণ প্রজন্মের কণ্ঠশিল্পীদের আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করেন?
নিগার সুলতানা পপি : এখনকার তরুণ প্রজন্মের ভিতর অনেক ভাল ভাল শিল্পী আছে এরা অনেকেই খুব ভালো গান করছেন। এরা যদি গানটিকে রেগুলার চর্চা করেন তাহলে ওরা খুব ভালো করবেন। গানযে গুরুমুখী বিদ্যা। আমি ওদেরকে অনুরোধ করবো রাতারাতি স্টার না হয়ে তারা যেন রেগুলার গানের চর্চা করে যায়।

উন্নয়ন বার্তা : বঙ্গবন্ধুকে একজন বাঙালি জাতীয়তাবাদী মহান নেতা হিসেবে কিভাবে মূল্যায়ন করেন?
নিগার সুলতানা পপি : জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে আসলে আমার মত একটা ক্ষুদ্র মানুষ তাঁকে মূল্যায়ন করার ভাষা আমার নেই। তিনি জাতির পিতা, তিনি বঙ্গবন্ধু, তিনি বাঙালির প্রাণ। আজকে তাঁর জন্যই আমাদের এই দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমরা একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি। আমি বলব আসলে উনার তুলনা শুধু উনি নিজেই।

উন্নয়ন বার্তা : প্রায় পঞ্চাশ বছর হতে চলেছে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এতগুলো বছরে বাংলাদেশের কি কি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন আছে বলে আপনি মনে করেন?
নিগার সুলতানা পপি : আমি খুব আশাবাদী। আমাদের এখন অনেকগুলো টিভি চ্যানেল এবং এফএম রেডিও চ্যানেল হয়েছে। আমি সরকারকে ধন্যবাদ জানাই আমাদের এতগুলো চ্যানেল হওয়ার কারণে আমাদের গানের অনেক প্রসার ঘটছে, অনেক শিল্পী গান গাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। তো আমি খুব ভালোভাবেই দেখছি এবং মিডিয়ার এই প্রচারের জন্যই আজকে আমাদের বাংলাদেশের গানগুলো বিশ্ব দরবারে পৌঁছে যেতে পারছে।

উন্নয়ন বার্তা : বাংলা ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় গান করেন কি? গানের সুবাদে কোন্ কোন্ দেশ ভ্রমণ করেছেন?
নিগার সুলতানা পপি : বাংলা ছাড়া আসলে অন্য ভাষায় আমার এখনো গান করা হয়নি। আর গানের সুবাদে আমি বাংলাদেশ ছাড়া ইন্ডিয়া ও সিঙ্গাপুরে আমি অনুষ্ঠান করেছি।

উন্নয়ন বার্তা : বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় সঙ্গীতকে পেশা হিসেবে নেয়ার ব্যাপারে আপনার পরামর্শ কি?
নিগার সুলতানা পপি : বাংলাদেশে বর্তমানে বাস্তবতা আসলে সংগীত কে পেশা হিসেবে নেওয়া এখন অনেক কঠিন, এটা একটা চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারপরও বলবো আমরা শত সমস্যা থাকার পরও গান করে যাচ্ছি।

উন্নয়ন বার্তা : অনেক বছর ধরেই বাংলাদেশের সঙ্গীতাঙ্গনে বিদেশি ইনস্টুমেন্ট ব্যাপকহারে ব্যবহৃত হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে যে, এতে করে কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রায় কেনা যন্ত্র ও লাইটগুলোর অপব্যবহারের ফলে কণ্ঠশিল্পীর মূল সুরটিই চাপা পড়ে যায়। আবার অতিমাত্রায় যন্ত্র ব্যবহারের ফলে সঙ্গীতের মাধুর্য্য ও প্রশান্তিদায়ী ক্ষমতাটুকুও আর থাকে না এক ধরনের শব্দ দূষণ তৈরির কারণে। তাই সঙ্গীতায়োজন একদিকে যেমন ব্যয়বহুল হচ্ছে, অন্যদিকে এর জগতটিও ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। আপনার মত কি?
নিগার সুলতানা পপি : আসলে সংগীতাঙ্গনে বিদেশে ইন্সট্রুমেন্ট ব্যবহার হচ্ছে। আমি বলব এটি আসলে খারাপ না। ব্যাপার হচ্ছে আপনি যখন একটি যন্ত্র ব্যবহার করবেন তখন সেই যন্ত্রের আওয়াজ যেন শিল্পীর কন্ঠ ছাপিয়ে না যায়। আমার অনুরোধ থাকবে- একটি গান যখন কম্পোজ করা হয় তখন তার ব্যালেন্সিং যদি ভাল হয় তাহলে সেই গানটি শ্রোতারা শুনতে পাবেন, কণ্ঠশিল্পীর মূল সুর তখন আর চাপা পড়বে না।