কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তা (এআই) পরিচালিত দামি স্ক্যানার নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। দেশটির কয়েকশ স্কুলে ৩৭ লাখ মার্কিন ডলার দামের এই স্ক্যানার ব্যবহার করা হয়। কিন্তু তথাকথিত অত্যাধুনিক এই নিরাপত্তা ব্যবস্থা সাধারণ ছুরিই শনাক্ত করতে পারছে না। ফলে স্কুলগুলোর হাজার হাজার শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
বিবিসির খবর অনুসারে, এআই স্ক্যানারের এই অক্ষমতার সুযোগে গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে স্কুলের ভেতর এক শিক্ষার্থীর ওপর ছুরি হামলার ঘটনা ঘটে। এ নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হলে পরে ওই স্ক্যানার সরিয়ে মেটাল ডিটেক্টর বসায় স্কুল কর্তৃপক্ষ। তবে বাকি স্কুলগুলোতে এখনো সেই বিতর্কিত স্ক্যানার ব্যবহার করা হচ্ছে, যা বড় ছুরি শনাক্তে অক্ষম।
গত বছর হ্যালোউইনে নিউইয়র্কে প্রক্টর হাই স্কুলের করিডোর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন এহনি লের হতো নামে এক শিক্ষার্থী। হঠাৎ আরেক শিক্ষার্থী পেছন থেকে তার ওপর ছুরি দিয়ে হামলা চালায়। ১৮ বছর বয়সী এহনির ঘাড়, মাথা, মুখ কাঁধ ও হাতে একাধিকবার ছুরিকাঘাত করা হয়।
অথচ সেই সময় প্রক্টর হাই স্কুলের প্রবেশপথে বসানো ছিল দামি এআই স্ক্যানার। এটি তৈরি করেছে ইভলভ টেকনোলজি নামে একটি মার্কিন কোম্পানি। প্রথাগত মেটাল ডিটেক্টরের জায়গায় এআই উইপন স্ক্যানার প্রতিস্থাপন করতে চায় কোম্পানিটি।
ইভলভের দাবি, শুধু ধাতু নয়, তাদের স্ক্যানার ‘প্রমাণিত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে শক্তিশালী সেন্সর প্রযুক্তি’ কাজে লাগিয়ে অস্ত্র শনাক্ত করতে সক্ষম। সিস্টেমটি ছুরি, বোমা বা বন্দুকের মতো কোনো গোপন অস্ত্র শনাক্ত করার সঙ্গে সঙ্গে অ্যালার্ম বাজিয়ে সবাইকে সতর্ক করে দেয়।
কোম্পানির প্রধান নির্বাহী পিটার জর্জ দাবি করেছেন, তাদের সিস্টেমের ‘সব ধরনের অস্ত্র’ চেনার ক্ষমতা রয়েছে। স্ক্যানারটি আগ্নেয়াস্ত্র, বিস্ফোরক ও ছুরি শনাক্ত করতে পারে বলে ইভলভের অতীত প্রেস রিলিজে দাবি করা হয়েছিল। কিন্তু বিবিসির অনুসন্ধান বলছে, ইভলভ টেকনোলজির এআই স্ক্যানার বড় ছুরি শনাক্তের ক্ষেত্রে মোটেও নির্ভরযোগ্য নয়। ২৪ ঘণ্টায় এর ভেতর দিয়ে যাওয়া-আসা করা ৪২ শতাংশ বড় ছুরি ধরতে পারেনি প্রায় ৪০ কোটি টাকার স্ক্যানারটি।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকশ স্কুল এবং প্রধান স্টেডিয়ামগুলোর পাশাপাশি যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার এরিনায় ব্যবহৃত হয় ইভলভের এই স্ক্যানার। পরীক্ষকরা বলেছেন, ইভলভের উচিত ছুরি না চেনার বিষয়টি সম্ভাব্য ক্রেতাদের কাছে জানিয়ে দেওয়া।
ছুরিকাঘাতের ঘটনা
২০২২ সালের মার্চ মাসে ১৩টি স্কুলের জন্য ইভলভের এআই স্ক্যানার সিস্টেম কেনে ইউটিকা স্কুল বোর্ড। গ্রীষ্মের ছুটির মধ্যে সেগুলো যথাস্থানে বসানো হয়।
ওই বছরের ৩১ অক্টোবরের একটি সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, এহনির ওপর আক্রমণকারী প্রক্টর হাইস্কুলে প্রবেশ করছে এবং ইভলভ উইপন স্ক্যানারের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে।
ইউটিকার স্কুলগুলোর সুপারিনটেনডেন্ট ব্রায়ান নোলান বলেন, ভয়ংকর ভিডিওটি দেখে আমরা সবাই একই প্রশ্ন করেছি: ছাত্রটি স্কুলে ছুরি পেলো কীভাবে?
আক্রমণে ব্যবহৃত ছুরিটি ছিল নয় ইঞ্চির বেশি লম্বা। ওই ঘটনায় ইউটিকার স্কুল কর্তৃপক্ষ অভ্যন্তরীণ তদন্ত শুরু করে।
হামলায় ব্যবহৃত ছুরি।
নোলান জানান, তদন্তে সিদ্ধান্ত হয়েছে, ইভলভ অস্ত্র শনাক্তকরণ সিস্টেম ছুরি শনাক্তের জন্য নকশা করা হয়নি।
ওই ঘটনার পর প্রক্টর হাই স্কুল থেকে এআই স্ক্যানারগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে এবং সেই জায়গায় ১০টি মেটাল ডিটেক্টর বসানো হয়েছে। তবে জেলার বাকি ১২টি স্কুলে এখনো ইভলভের স্ক্যানার ব্যবহৃত হচ্ছে।
নোলান জানান, সেই হামলার পর থেকে ইউটিকার অন্য স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আরও তিনটি ছুরি পাওয়া গেছে। তবে সেগুলো ইভলভ স্ক্যানারে ধরা পড়েনি। বরং কর্মীদের কাছে রিপোর্ট করা হয়েছিল বলেই ছুরিগুলো পাওয়া গেছে।
তিনি বলেন, বাচ্চারা [যাদের কাছে ছুরি ছিল] সবাই বলেছে, তারা অস্ত্র শনাক্তকরণ ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে হেঁটে এসেছে… এটি সত্যিই ছুরি খুঁজে পায় না।
ইভলভের ওয়েবসাইটে পরিবর্তন
প্রক্টর হাই স্কুলে ছুরিকাঘাতের ঘটনার পর ইভলভ টেকনোলজির ওয়েবসাইটের স্লোগানে পরিবর্তন আনা হয়েছে।
গত অক্টোবরের আগপর্যন্ত ওয়েবসাইটটিতে কোম্পানির লক্ষ্য সম্পর্কে লেখা ছিল, ‘অস্ত্রমুক্ত অঞ্চল তৈরি’ (উইপনস-ফ্রি জোন)। এরপর সেটি পরিবর্তন করে প্রথমে লেখা হয় ‘নিরাপদ অঞ্চল’ (সেফ জোন)। পরে শব্দগুলো ফের সংশোধন করে লেখা হয়েছে ‘নিরাপদতর অঞ্চল’ (সেফার জোন)।
আরও পড়ুন>> যে কারণে যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি বন্দুক হামলা হয়
স্কুলগুলোতে বসানো ইভলভের এআই স্ক্যানার ছুরি শনাক্ত করতে পারেনি, এ বিষয়ে প্রশ্ন করেছিল বিবিসি। তবে তার কোনো জবাব দেয়নি মার্কিন কোম্পানিটি।