গাজীপুর সিটি নির্বাচন: ৫ বছর পূর্ণ করতে পারেননি ২ মেয়র

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের (গাসিক) সাবেক মেয়র (মৃত) অধ্যাপক এমএ মান্নান ও মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হন। তবে তারা কেউ পূর্ণ মেয়াদে দায়িত্ব পালন করতে পারেননি।

এদের একজন বহিষ্কার হয়ে ২২ মাস জেল খেটেছেন ও আরেকজন জেল না খাটলেও ১৮ মাস ধরে চেয়ারে বসতে পারেননি। ওই দুই মেয়রের অবর্তমানে কৌশলে একজন কাউন্সিলর প্রায় পাঁচ বছর ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রথম দফায় ওই কাউন্সিলরের প্যানেল মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পেছনেও ছিল নানা প্রশ্ন। দ্বিতীয় মেয়াদে তিনি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে তদবির করে সরাসরি ভারপ্রাপ্তের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালনে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ উঠে। এ বিষয়ে উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন হলে বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়। তার বিরুদ্ধে আমেরিকায় সেকেন্ড হোম গড়ার অভিযোগ রয়েছে।

২০১৩ সালে পাঁচ সিটি নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন বিএনপির প্রার্থীরা। এর মধ্যে বরিশালের মেয়র ছাড়া মামলার অজুহাতে বাকি চার মেয়রকে দায়িত্ব থেকে অপসারণ করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র এমএ মান্নান নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়েছেন মাত্র ১৮ মাস। জেলে কাটিয়েছেন ২২ মাস। তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল ২৯টি। বরখাস্ত হয়েছিলেন দুইবার।

বিশেষ করে সাড়ে তিন বছরে ২৯টি মামলা এবং দুই দফায় বরখাস্তের ঘটনাকে ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার প্রতিফলন হিসেবে দেখেন নগরবাসী। তার অবর্তমানে ভারপ্রাপ্ত মেয়র হয়েছেন আওয়ামী লীগ দলীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর আসাদুর রহমান। তিনি মহানগরের টঙ্গী জোনের ৪৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ছিলেন। এ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য পদপ্রার্থী ছিলেন; কিন্তু তিনি দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে কাউন্সিলর নির্বাচনে অংশ নেননি।

২০১৩ সালের ৬ জুলাই প্রথম দফায় গাজীপুর সিটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খানের চেয়ে ১ লাখ ৬ হাজার ৬৬৬ ভোট বেশি পেয়ে জয়ী হন বিএনপি নেতা অধ্যাপক এমএ মান্নান। নির্বাচনের দেড় মাস পর ১৮ আগস্ট তিনি দায়িত্বভার বুঝে নেন। ১৮ মাসের মাথায় ২০১৫ সালের ১১ ফেরুয়ারি জয়দেবপুর থানা পুলিশ একটি নাশকতা মামলায় তাকে তার ঢাকার বাসা থেকে গ্রেফতার করে। ১২ মাস ১৮ দিন কারাভোগের পর ১৬ সালের ২ মার্চ তিনি মুক্তি পান। ৪২ দিনের মাথায় ১৫ এপ্রিল তিনি আবারো গ্রেফাতার হন। ৮ মাস ২২ দিন কারাবন্দি থাকার পর ১৭ সালের ৭ জানুয়ারি দ্বিতীয় দফায় তিনি মুক্তি পান।

তৎকালীন গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলার বিষয়টি সমর্থন করেননি। ওই নির্বাচনে মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম আওয়ামী লীগের মেয়র পদপ্রার্থী ছিলেন। পরে তিনি বহু নাটকীয়তার পর আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খানকে সমর্থন দিয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান।

পরে ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় মেয়াদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে জাহাঙ্গীর আলম বিএনপি প্রার্থী বীর মুক্তিযোদ্ধা হাসান উদ্দিন সরকারকে বিপুল ভোটে হারিয়ে মেয়র নির্বাচিত হন। কিন্তু মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও দলীয় মেয়র হয়েও তিনি তার নির্ধারিত মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি।

২০২১ সালের ১৯ নভেম্বর গোপনে ধারণ করা মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের কথোপকথনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল করা হয়। এতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জেলার কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করতে শোনা গেছে। এ নিয়ে আন্দোলনে নামেন জাহাঙ্গীর বিরোধীরা। স্থানীয় আওয়ামী লীগের মধ্যে বিভক্তি শুরু হয়। এতে গাজীপুরের বড় একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতা এবং তাদের অনুসারীরা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে এককাট্টা হয়ে যায়। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে জাহাঙ্গীর আলমকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়।

নি:র্শত ক্ষমা চেয়ে ভাইরাল হওয়া ভিডিওটি ‘সুপার এডিট’ করা বলে দাবি করেন জাহাঙ্গীর আলম। কিন্তু আওয়ামী লীগ তাতে সন্তুষ্ট হতে পারেনি। এ ঘটনায় দল থেকে বহিষ্কারের ৭ দিন পর ২৫ নভেম্বর তাকে মেয়র পদ থেকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

এর রেশ ধরে মেয়রবিরোধী অতিউৎসাহীরা তার ঘনিষ্ঠদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাসা-বাড়িতে ভাঙচুর ও হামলার ঘটনা ঘটায়। শোকজ নোটিশ দেওয়া হয় মহানগর আওয়ামী লীগের কয়েকজন সিনিয়র নেতাসহ সহযোগী সংগঠনের অনেককে। জাহাঙ্গীরের সঙ্গে সম্পর্ক রাখায় সম্প্রতি কয়েকজনকে পার্টি থেকে বহিষ্কারও করা হয়েছে।