উন্নয়ন ডেস্ক –
করোনার ভুয়া সনদ প্রদানসহ অসংখ্য অভিযোগে সিলগালা করে দেওয়া রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদকে ঘিরে নানা গুঞ্জন তৈরি হয়েছে। তিনি আদৌ দেশে আছেন নাকি বিদেশে পালিয়ে গেছেন, তা নিয়ে চলছে আলোচনা। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সাহেদের প্রভাব দেখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাই বিস্মিত। তিনি কাউকে পাত্তাই দিতেন না। এমনকি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সতর্কতাকেও পরোয়া করেননি তিনি। মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা তাকে মৌখিকভাবে একাধিকবার সতর্ক করেছিলেন। এমনকি তার বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যাওয়ার বিশেষ নির্দেশনাও কাজে আসেনি। মন্ত্রণালয় তাকে ‘ভয়ংকর প্রতারক’ বলে আখ্যা দিয়েছিল। তারপরও তার বিরুদ্ধে নেওয়া হয়নি কোনো ধরনের ব্যবস্থা। উল্টো সাহেদ হয়ে ওঠেন বেপরোয়া। সরকারের শীর্ষ মহলের নাম ব্যবহার করে নানা অপকর্ম চালিয়ে আসছিলেন তিনি। রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরা শাখার একটি কক্ষে সাহেদ কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ অন্যদের আটকে নির্যাতন চালাতেন বলে জানা গেছে। তার প্রভাব-প্রতিপত্তি দেখেই প্রশাসন থাকত নীরব।
এদিকে, সাহেদ যাতে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে না পারেন, সে জন্য পুলিশ সদর দপ্তর দেশের সব কটি বিমানবন্দর ও সীমান্ত এলাকায় ছবিসহ নোটিস জারি করেছে। তা ছাড়া লাইসেন্স নবায়ন না করে রিজেন্ট হাসপাতাল কীভাবে করোনা চিকিৎসার অনুমতি পেয়েছে তার ব্যাখ্যা চেয়েছে সরকারের শীর্ষ মহল। এ নিয়ে খোদ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ‘তদন্তে’ নেমেছে।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সাহেদকে ধরতে বুধবার রাতভর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়েছে র্যাব ও পুলিশ। এ ছাড়া রিজেন্ট গ্রুপের আইটিপ্রধান ও জনসংযোগ কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম ওরফে তারেক শিবলীকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। সাহেদের ভায়রা ও নাট্যনির্মাতা মোহাম্মদ আলী বশিরকেও আটক করা হয়েছে। তবে তাকে গ্রেপ্তারের সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানিয়েছে র্যাব। এই মামলায় বর্তমানে রিমান্ডে থাকা ৭ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। তাদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। সংশ্লিষ্টরা মিডিয়াকে জানিয়েছেন, বছর চারেক আগে মোহাম্মদ সাহেদের প্রতারণার বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক অধিশাখার উপসচিব নওয়াব আলী স্বাক্ষরিত একটি চিঠি আসে তৎকালীন মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) কাছে। ওই চিঠিতে বলা হয়, সাহেদ নিজেকে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা ও ক্যাডেট কলেজের শিক্ষার্থী পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন অপকর্ম করে আসছেন। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর এডিসি ছিলেন বলেও পরিচয় দিয়ে আসছেন। এই ব্যক্তি ‘ভয়ংকর প্রতারক’। তার বিরুদ্ধে ৩২টি মামলা রয়েছে, তিনি দুই বছর কারাগারে ছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়। এরপরও তার বিষয়ে তেমন কোনো আইনি প্রক্রিয়া নেওয়া হয়নি। উল্টো এই চিঠির পরও ২০১৭ সালে সাজেক ভ্রমণে গেলে সেখানে তিনি পুলিশ প্রোটেকশন পান। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও তাকে হর্তাকর্তাদের সঙ্গে খোশগল্প ও ছবি তুলতে দেখা যেত। সে ছবি ব্যবহার করেই তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করতেন। বাড়িওয়ালার ভাড়া থেকে অন্যান্য নিরীহ লোকের পাওনা পরিশোধ না করে তার বিরুদ্ধে অস্ত্রের মুখে হুমকি দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এমনকি উত্তরার যে বাড়িতে রিজেন্ট গ্রুপের অফিস, সেখানে এক পুলিশ কর্মকর্তার পরিবারের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পাল্টা হুমকি দিয়েছেন সাহেদ।
পুলিশের এক কর্মকর্তা মিডিয়াকে বলেন, ‘কয়েক বছর ধরেই মন্ত্রণালয় ও পুলিশের কাছে সাহেদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আসে। মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্তারা তাকে ভালো হয়ে যেতে একাধিকবার সতর্ক করেছিলেন। এমনকি তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছিল আমাদের। তাকে প্রটোকল যাতে কেউ না দেয়, সে জন্য সতর্কও করা হয়েছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘তার প্রভাব-প্রতিপত্তি দেখে আমরা কোনো ব্যবস্থা নিতে পারিনি। আমাদের সিনিয়র স্যারদের মধ্যে কেউ কেউ তাকে আশ্রয়-প্রশয় দিতেন। পুলিশ, র্যাবসহ সব কটি সংস্থার অনুষ্ঠানে সামনের সারিতে বসতেন।’ তার সহায়-সম্পদের খোঁজে দুদক কাজ করবে আর বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংক হিসাব খতিয়ে দেখবে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, রিজেন্টের আইটিপ্রধান তারেক শিবলীকে গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তার কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। সাহেদকে ধরার চেষ্টা চলছে।
র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম বলেন, ‘তারেকের কাজ ছিল মূলত আইটি বিভাগ সামাল দেওয়া। করোনার নকল সনদ তৈরির বিষয়ে তারেক শিবলী অত্যন্ত নিপুণ কায়দায় নিজেই দায়িত্ব পালন করতেন। কম্পিউটার থেকে প্রিন্ট নেওয়া, রিপোর্ট নেগেটিভ-পজিটিভ করার মতো কঠিন দায়িত্বটা তিনিই পালন করতেন। সাহেদ তাকে দিয়েই বিশ্বস্তার সঙ্গে সনদ তৈরি করাতেন। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা গেলে জানা যাবে, এ পর্যন্ত কত সংখ্যক সনদ তৈরি করা হয়েছে। কত লোক প্রতারণার শিকার হয়েছে, সে তথ্যও তার কাছে রয়েছে।’
র্যাবের এক কর্মকর্তা মিডিয়াকে বলেন, ‘বর্তমানে টিভি নাটকের অন্যতম প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘টেলিহোম-এর স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ আলী বশিরকে সার্বিকভাবে আর্থিক সহায়তা দিতেন সাহেদ। মূলত তার অবৈধ টাকা দিয়ে আলী বশির নাটক প্রযোজনা করতেন। সাহেদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করতে বুধবার রাতে বনানীর অফিস থেকে তাকে আটক করে আনা হয়। এই অভিযোগে এবং সাহেদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে আনা হয়েছে। তাকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।’
পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, প্রতারক সাহেদ যাতে দেশ ছেড়ে পালাতে না পারেন, সে জন্য গতকাল সীমান্তে বিশেষ বার্তা পাঠানো হয়েছে। তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে ইমিগ্রেশন পুলিশকে চিঠি দিয়েছে ডিএমপির সংশ্লিষ্ট বিভাগ। তিনি বলেন, ‘রিজেন্ট হাসপাতালের একটি কক্ষ ছিল সাহেদের টর্চার সেল। ওই সেলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নির্যাতন চালানো হতো।’ সাহেদকে আটক না করার বিষয়ে কোনো চাপ রয়েছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কিসের চাপ। তার মতো ক্রিমিনালের জন্য কে আবার তদবির করবে। যে এ ঘটনায় তদবির করবে, তাকেও ধরা হবে। জিরো টলারেন্স নীতি নিয়েই র্যাব কাজ করছে।’
এদিকে, দেশ-বিদেশে রিজেন্টের তোলপাড় করা এ ঘটনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়েরও টনক নড়েছে। লাইসেন্স নবায়ন না করেই কীভাবে রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে কভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য চুক্তি করা হলো— মন্ত্রণালয় থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব উম্মে হাবিবা স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, ৬ জুলাই হাসপাতালটিতে চালানো র্যাবের অভিযান ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হাসপাতালটির নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দেশ ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়েছে। চিঠিতে হাসপাতালটির সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সমঝোতা চুক্তি বাতিল করতেও বলা হয়। এ ছাড়া সমঝোতা চুক্তির শর্ত ভেঙে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নমুনা সংগ্রহ ও ভুয়া রিপোর্ট দেওয়ার বিষয়ে তদন্ত করে দ্রুত মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠাতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে হাসপাতালটির সব কার্যক্রম বাতিল ও সিলগালা করার জন্যও বলা হয়েছে।