জনগণকে বাঁচানো যাবে না স্বাস্থ্য খাতের উন্নতি করা না গেলে

উন্নয়ন ডেস্ক –

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান এবং বর্তমান ইউজিসি অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ স্বাস্থ্য সচেতনতা বিষয়ক লেখালেখির জন্য সুপরিচিত। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন জাতীয় সংবাদপত্রে নিয়মিত স্বাস্থ্য বিষয়ক কলাম লিখেছেন এবং পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। একই সঙ্গে চিকিৎসাশাস্ত্রের শিক্ষার্থীদের জন্য ছয়টির বেশি মেডিকেল পুস্তক রচনা করেছেন তিনি। চিকিৎসা গবেষণায় অবদানের জন্য ২০১৬ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন খ্যাতিমান এই অধ্যাপক। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। দেশে করোনাভাইরাস মহামারীর সাম্প্রতিক গতি-প্রকৃতি এবং স্বাস্থ্যসেবা পরিস্থিতি নিয়ে মিডিয়াকে সঙ্গে কথা বলেছেন অধ্যাপক এ বি এম আব্দুল্লাহ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিডিয়ার সম্পাদকীয় বিভাগের আহমেদ মুনীরুদ্দিন

সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনতে লকডাউন ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কৌশলগুলো যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে না পারায় দেশে করোনাভাইরাসে সংক্রমণ ও মৃত্যু দুটোই দ্রুতগতিতে বাড়ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে সংক্রমণ শনাক্তের প্রথম ১২০ দিনে করোনায় মারা গেছেন মোট ২ হাজার ৫২ জন। এর মধ্যে প্রথম ৯৫ দিনে ১ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আর পরের মাত্র ২৫ দিনেই মারা গেছেন ১ হাজার ৪০ জন। এসব পরিসংখ্যান দেশে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারার কঠিন পরিস্থিতি সম্পর্কে হুঁশিয়ারি বার্তা দিচ্ছে। আপনি কী মনে করেন?

এ বি এম আব্দুল্লাহ : আসলেই করোনার সংক্রমণও বাড়ছে, সঙ্গে মৃত্যুর হারও বাড়ছে। জুন মাসে সম্ভবত সংক্রমণের হার সবচেয়ে বেশি ছিল। মে মাসেও বেড়েছে। তবে জুনে সেটা আরও বেড়ে গেল। মনে হচ্ছে আমরা এখনো সংক্রমণের পিক-এ আছি বা সর্বোচ্চ চূড়ার দিকেই যাচ্ছি। এখনো প্রতিদিন গড়ে আক্রান্তের হার তিন থেকে চার হাজার। পরীক্ষার হার আরও বাড়াতে পারলে হয়তো আরও স্পষ্ট বোঝা যেত। আতঙ্ক বা উদ্বেগের কারণ হচ্ছে মৃত্যুর হার বাড়তে থাকা। সংক্রমণ বাড়তে থাকলে মৃত্যুর ঝুঁকি তো থাকবেই। আসলে যারা মারা যাচ্ছেন তাদের বেশিরভাগই যেমন বয়স্ক মানুষ, তেমনি তারা অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণে ধকল সামাল দিতে পারছেন না। ডায়াবেটিস, হাইপ্রেশার, কিডনির রোগ, লিভারের রোগ বা যারা ক্যানসারের জন্য কেমোথেরাপি নিয়েছেন এমন রোগীরা করোনায় বেশি মারা যাচ্ছেন। তবে, আমার ধারণা আগামী দুএক সপ্তাহে হয়তো আমরা বুঝতে পারব সংক্রমণটা কমে আসবে কি না। বিপুল সংখ্যক মানুষ মাস্ক পরেন না, শারীরিক দূরত্ব বজায় না রেখে জনসমাগমে যাচ্ছেন এবং হাত ধোয়ার মতো সাধারণ স্বাস্থ্যবিধিও মানছেন না।

জনগণের সচেতনতার যে অভাবের কথা আপনি বললেন তার সঙ্গে কি সরকারের প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার ঘাটতিও একটা ভূমিকা রাখছে? বিশেষত সারা দেশকে সংক্রমণের ঘনত্ব বিবেচনায় রেড, ইয়েলো ও গ্রিন জোনে ভাগ করে রেড জোনগুলোতে পুরোপুরি লকডাউন করার একটা সিদ্ধান্ত সরকার এক মাসেরও বেশি আগে নিয়েছে। কিন্তু ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ৪৫ এলাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ১১ এলাকাসহ ১৯ জেলার যে ১১৮টি এলাকাকে রেড জোন ঘোষণা করা হলো সে সবের বেশিরভাগ স্থানেই লকডাউন শুরু হয়নি। জনস্বাস্থ্যবিদরা বলেছেন, সংক্রমণ রোধে সব স্থানে একসঙ্গে লকডাউন না করে বিচ্ছিন্ন লকডাউনে আসলে সুফল পাওয়া যাচ্ছে না।

এ বি এম আব্দুল্লাহ : আসলে একসঙ্গে লকডাউন করার কিছু সমস্যা তো আছেই। শুরুর দিকে তো করা হয়েছিল। কিন্তু মুশকিল হলো জনগণ তো মানে না। দ্বিতীয় কথা হলো একটা দেশে লকডাউন করে মানুষকে কতদিন আর বন্দি করে রাখা যাবে? সবচেয়ে বড় কথা হলো করোনা কতদিনে যাবে, সংক্রমণ কতদিন থাকবে এ বিষয়ে তো কেউই সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারছেন না। এদিকে, মানুষ তো জীবিকার কারণে ঘর থেকে বের না হয়ে পারছে না। বিশেষত যারা দিন আনে দিন খায়- শ্রমিক শ্রেণি, রিকশাওয়ালা, গার্মেন্টসের শ্রমিক, দিনমজুর এদের পক্ষে তো লকডাউনে থাকা সম্ভব না। তিন মাসের লকডাউনে এরা তো কাজ হারিয়ে মারাত্মক দুর্যোগের মধ্যে পড়ে গেছে। যদিও আমরা বলি, আগে জীবন পরে জীবিকা। কিন্তু আসলে জীবন ও জীবিকা দুটোই গুরুত্বপূর্ণ। একটা ছাড়া আরেকটা দিয়ে চলবে না।

এক্ষেত্রে এলাকাভিত্তিক লকডাউনের যে সিদ্ধান্ত সরকার দিয়েছে সেটা হয়তো বেটার কাজে আসত। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এই সিদ্ধান্তটা বাস্তবায়নেও একটা ঢিলেঢালা ভাব আছে। দুই সপ্তাহ তিন সপ্তাহ এরকম করে দেখা যেতে পারে কাজ হয় কি না। নাহলে পরে হয়তো বড় আকারে সবখানে লকডাউনের চিন্তাও করতে হতে পারে। এজন্য এলাকাভিত্তিক জোন হিসেবে লকডাউনটা দ্রুত কার্যকর করা দরকার। তবে, সেটা করতে হলে আসলে স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। প্রতিটা এলাকার যারা নেতৃস্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনার, কাউন্সিলর, মসজিদের ইমাম, স্কুলের হেডমাস্টার, রাজনৈতিক নেতা, সাংস্কৃতিক সংগঠক এমন সবাইকে নিয়ে এলাকার মানুষজনকে বুঝিয়ে শুনিয়ে লকডাউনে যেতে হবে। সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, পুলিশ-র‌্যাবকেও সম্পৃক্ত করতে হবে। যাতে সবাই সহযোগিতা করে, নিয়ম মেনে চলে।

করোনা মহামারী মোকাবিলায় সংক্রমণ রোধ করার জন্য লকডাউনসহ শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পাশাপাশি বেশি বেশি নমুনা পরীক্ষার ওপর জোর দিয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। আমাদের দেশে পরীক্ষার হার আগের তুলনায় বাড়লেও আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বিবেচনায় এখনো তা অনেক কম। কিন্তু বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি করোনা সংক্রমিত শীর্ষ বিশটির একটি। আমরা করোনা পরীক্ষার সংকট কাটিয়ে উঠতে পারছি না কেন?

এ বি এম আব্দুল্লাহ : দেশে ১৭/১৮ কোটি মানুষ। সে হিসাবে পরীক্ষার হার তো আসলেই কম। অবশ্য শুরুর দিকের চেয়ে এখন বেশ কিছুটা উন্নতি হয়েছে। আগে একটা কেন্দ্রে পরীক্ষা হতো এখন ৭৩টা কেন্দ্রে পরীক্ষা হচ্ছে। তবে, পরীক্ষার হার বাড়াতে হলে যেমন যন্ত্রপাতি লাগবে তেমনি লোকবলও লাগবে। পিসিআর মেশিন লাগে, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট লাগে। এসব কারণেই সমস্যা হচ্ছে। তবে এই সংকটটা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করতে হবে। সরকার নিশ্চয়ই চেষ্টা করছে, সেটা আরও জোরদার করতে হবে।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত নানা প্রতিবেদনে মহামারীর কালে দেশের স্বাস্থ্য খাতের ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা এবং নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। করোনা পরীক্ষা করা থেকে হাসপাতালগুলোর চিকিৎসাসেবায় অবহেলার অভিযোগ উঠেছে। একইসঙ্গে চিকিৎসক-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীদের নিম্নমানের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী সরবরাহেরও অভিযোগ আছে। সব মিলিয়ে মহামারীর সময়ে স্বাস্থ্যসেবা খাতের যে চিত্র দেশের মানুষের সামনে এলো সেটা খুবই হতাশাজনক। আপনার মূল্যায়ন কী?

এ বি এম আব্দুল্লাহ : এগুলো তো নতুন না। স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি অনেক পুরনো, এটা তো সত্য। এখন করোনা মহামারীর সময়ে এসব দুর্নীতি উন্মোচিত হচ্ছে। দুর্নীতি, অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা এগুলো তো দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। জনগণ যেটা বিশ্বাস করে যে, আমাদের সমন্বয়ের অভাব, সততার অভাব, অদক্ষতা এগুলো তো আমাদের বাস্তবতা। এর মধ্যেও কিছু লোক যারা অতি মুনাফালোভী, তাদের ধরা দরকার। হয়তো একটা দুইটা ধরা পড়ছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, একদম টপ লেভেল থেকে রুট পর্যন্ত সবখানেই দুর্নীতিবাজ আছে। এখন এগুলো কঠোর হস্তে দমন করা দরকার। এটা দ্রুত করা দরকার। কারণ স্বাস্থ্য খাতের উন্নতি করা না গেলে তো জনগণকে বাঁচানো যাবে না।

মহামারীর এই জাতীয় দুর্যোগের মধ্যেও করোনা পরীক্ষার ফল জালিয়াতির ঘটনায় বিশ্বজুড়ে আলোচনায় এলো বাংলাদেশের নাম। সম্প্রতি বেসরকারি রিজেন্ট হাসপাতালের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, করোনার নমুনা সংগ্রহ করলেও পরীক্ষা না করেই পজিটিভ বা নেগেটিভ রেজাল্ট দিয়েছে তারা। রিজেন্ট হাসপাতাল কত সংখ্যক মানুষের নমুনা পরীক্ষা করেছে সেটা আমরা জানি না। কিছুদিন আগে বেসরকারি সংস্থা জেকেজির বিরুদ্ধেও একইরকম অভিযোগ উঠেছে। করোনা পরীক্ষার এই জালিয়াতির কারণে এখন সারা দুনিয়ায় বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রম রপ্তানির বাজারও হুমকির মুখে পড়ে যাচ্ছে। মানুষের জীবন-মরণ নিয়ে এমন জালিয়াতির প্রতিকার কী?

এ বি এম আব্দুল্লাহ : এটা তো ভয়াবহ প্রতারণা। এমন দুর্যোগে মানুষ মানবতার হাত বাড়িয়ে দেবে। কিন্তু এরা মানুষের জীবন-মরণ সংকটের কালে এমন মারাত্মক জালিয়াতি করল। এটা চিন্তা করাই দুরূহ। এমন প্রতারণার কারণে এখন বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। বিদেশে শ্রমবাজারও বড় সংকটে পড়ল। এই যে ইতালি থেকে যে বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠানো হলো তারা হয়তো এসব প্রতিষ্ঠানের কোনো একটা থেকেই পরীক্ষা করিয়েছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকার এ বিষয়ে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। কিন্তু এখন আরও তদন্ত হওয়া দরকার যে আরও কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান এ ধরনের জালিয়াতি করছে কি না। এসব জালিয়াতি এবং মানুষের জীবন নিয়ে প্রতারণাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। যাতে মানুষের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা নিয়ে কেউ কোনোদিন জালিয়াতি করার সাহস না পায়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, দেশে এখন করোনা আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে মাত্র ৫ শতাংশ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। আর প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আইসোলেশনে আছেন প্রায় ১৯ শতাংশ। সবমিলে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সেবার আওতায় আছেন মোট রোগীর ৪ ভাগের ১ ভাগ। বাকিরা বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এদিকে, করোনার চিকিৎসায় নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতে ১৪ হাজার ৯৪৫টি সাধারণ শয্যার ১০ হাজার ৭৬৯টিই খালি। এসব হাসপাতালের ৩৯৪টি নির্ধারিত আইসিইউর মধ্যে ২০০টি আইসিইউ খালি। সব রোগীর অবশ্যই হাসপাতালে যাওয়ার দরকার নেই। কিন্তু আপনার কি মনে হয় হাসপাতালমুখী না হওয়ার পেছনে মানুষের আস্থাহীনতার কোনো মনস্তত্ত্ব কাজ করছে?

এ বি এম আব্দুল্লাহ : ৮০ ভাগ রোগীর চিকিৎসা আসলে বাড়িতেই সম্ভব। ১০ থেকে ২০ ভাগ রোগীর চিকিৎসকের কাছে যেতে হয়। আর মাত্র ৫ ভাগের মতো রোগীর হয়তো আইসিইউ প্রয়োজন হয়। সে হিসেবে পরিস্থিতি একরকম ঠিকই আছে। আর আসলে হাসপাতালগুলো তো এমনিতেই নানা রোগজীবাণু সংক্রমণের বড় স্থান। এই সময়ে সেখানে যেমন করোনা রোগী আছে তেমনি অন্যান্য অনেক রোগীও আছে। সেক্ষেত্রে বিশেষ প্রয়োজন না হলে হাসপাতাল এড়িয়ে চলার চিন্তা ঠিকই আছে। যদি শ্বাসকষ্ট না হয়, অক্সিজেন না লাগে তাহলে বাড়িতে থাকাই ভালো। বাড়িতে থেকে চিকিৎসা করাতে পারলে রোগীর জন্য সেটা মানসিকভাবেও ভালো। আর এখন আমাদের দেশে তথ্যপ্রযুক্তি ও যোগাযোগ ব্যবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। করোনার সময়ে একটা বড় অংশের মানুষ টেলি-মেডিসিন বা টেলিফোনে ডাক্তারদের কাছ থেকে চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন। এটা অবশ্যই একটা বড় অগ্রগতি।