জলাবদ্ধতায় নাকাল রাজধানীবাসী

উন্নয়স ডেস্ক –

টানা বৃষ্টির কারণে আবারও ডুবেছে রাজধানীর বেশির ভাগ সড়ক ও অলিগলি। কোথাও হাঁটু ও কোথাও কোমর সমান পানি। ফলে স্বাভাবিক চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে। বছর জুড়ে সড়কে বিভিন্ন সংস্থার খোঁড়াখুঁড়ি চললেও জলাবদ্ধতা সমস্যার নিরসন হয়নি। সামান্য বৃষ্টির পানিতেই নাকাল হয় নগরবাসী। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, ‘যেসব এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা যাচ্ছে সেসব এলাকায় উন্মুক্ত জায়গা বা মাটির অস্তিত্ব নেই। সে কারণেই আবদ্ধ পানি মাটি শোষণ করে নিতে পারছে না। ফলে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। যদি পানি মাটি শোষণের সক্ষমতার পাশাপাশি খাল ও ড্রেনগুলো সচল থাকতো তাহলে এই ভয়াবহ জলাবদ্ধতা দেখা যেতো না।’

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ বলেন, সেবা সংস্থার মধ্যেও সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। সমন্বিত পরিকল্পনার অভাবেই প্রতি বছর রাজধানীবাসীকে জলাবদ্ধতার সমস্যায় পড়তে হয়। তিনি বলেন, বর্ষা মৌসুমে যখন পানি উঠে তখনি এসব বিষয়ে কথা উঠে। এর আগে ওয়াসা কী করে সেটি সিটি করপোরেশন জানে না, আবার সিটি করপোরেশন কী করে সেটি ওয়াসা জানে না। এমন সমন্বয়ের অভাবেই দিন দিন সমস্যা বাড়ছে।

গত সোমবার ভোর থেকে বৃষ্টির কারণে গাবতলী থেকে নিউমার্কেট পর্যন্ত সড়ক, শান্তিনগর, বাড্ডা, মিরপুর, কাওরান বাজার, মতিঝিলসহ বেশিরভাগ সড়কে দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা। জলাবদ্ধতার মূল কারণ নিয়ে ২০১৭ সালে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। এতে দেখা যায়, রাজধানী ঢাকায় ৪৩টি খাল ছিল। এসব খালের মধ্যে ২৬টি ঢাকা ওয়াসা ও আটটি ঢাকা জেলা প্রশাসন রক্ষণাবেক্ষণ করছে। আর ৯টি খাল বক্স-কালভার্ট, রাস্তা ও স্যুয়ারেজ লাইনে পরিণত করা হয়েছে। এসব খালের অধিকাংশ স্থানে প্রভাবশালীরা দখল করে বহুতল ভবন, দোকানপাট ও ময়লা-অবর্জনা ফেলে ভরাট করে রেখেছে। ফলে খালে পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক জায়গায় বিলীন হয়ে গেছে খালের অস্তিত্ব। এতগুলো খাল থাকার পরেও কোনো সুফল ?পাওয়া যাচ্ছে না। এর মধ্যে সেসব খাল এখনো কোনো রকম টিকে আছে সেগুলোতে নেই পানিপ্রবাহ। ফলে সামান্য বৃষ্টি হলেই নগর জুড়ে তীব্র জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়।

ডিএনসিসির প্রতিবেদনে দেখা গেছে, যেসব খাল রয়েছে এর মধ্যে রামচন্দ্রপুর খাল ১০০ ফুটের জায়গায় ৬০ ফুটের অস্তিত্ব রয়েছে, মহাখালী খাল ৬০ ফুটের জায়গায় ৩০ ফুট, প্যারিস খাল ২০ ফুটের জায়গায় ১০-১২ ফুট, বাইশটেকি খাল ৩০ ফুটের জায়গায় ১৮-২০ ফুট, বাউনিয়া খাল ৬০ ফুটের জায়গায় ৩৫-৪০ ফুট, দ্বিগুণ খাল ২০০ ফুটের জায়গায় ১৭০ ফুট, আবদুল্লাহপুর খাল ১০০ ফুটের জায়গায় ৬৫ ফুট, কল্যাণপুর প্রধান খাল ১২০ ফুটের জায়গায় স্থানভেদে ৬০ থেকে ৭০ ফুট, কল্যাণপুর খালের বিশাল অংশে এখন সরু ড্রেন, রূপনগর খাল ৬০ ফুটের জায়গায় ২৫ থেকে ৩০ ফুট, কাটাসুর খাল ২০ মিটারের জায়গায় ১৪ মিটার, ইব্রাহিমপুর খালের কচুক্ষেত সংলগ্ন মাঝামাঝি স্থানে ৩০ ফুটের জায়গায় ১৮ ফুট রয়েছে। বেশির ভাগ খালের অংশই দখল হয়ে গেছে। এসব খাল ও ড্রেন সচল করার জন্য প্রতি বছর শত শত কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয় সংস্থাগুলোতে। এ বছর সড়ক, ফুটপাত ও সারফেস ড্রেন নির্মাণে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) বরাদ্দ ছিল ৬৬৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা। আর আগের অর্থবছরে (২০১৮-১৯) ব্যয় করা হয়েছে ৫৯৯ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। আর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ব্যয় করা হয়েছে ৭১৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। একইভাবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে এই খাতে গত অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ২৭২ কোটি টাকা। কিন্তু ব্যয় হয়েছে ১৫৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২২৪ কোটি টাকা। সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি ঢাকা ওয়াসাও তাদের নিজস্ব ড্রেন পরিষ্কারের পেছনে ব্যয় করে বড় অঙ্কের টাকা। জলাবদ্ধতার জন্য এত টাকা ব্যয় করা হলেও এই দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পাচ্ছে না নগরবাসী।

জলাবদ্ধতার বিষয়ে ওয়াসার পরিচালক (কারিগরি) শহীদ উদ্দিন বলেন, সামান্য এবং স্বল্প সময়ের বৃষ্টিতে তো পানি জমে না। পানি বিভিন্ন ড্রেনের মধ্য দিয়ে খালে যায়। পরে খালের মাধ্যমে পানি নদীতে গিয়ে পড়ে। এই সময়টুকু তো দিতে হবে। আর এখন বন্যার কারণে ঢাকার আশপাশের নদীগুলোতেও পানির উচ্চতা বেশি। তাই এই বৃষ্টির পানি নামতেও সময় লাগছে। তবুও ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় আমাদের পাম্প রয়েছে পানি সরিয়ে দেওয়ার জন্য। নদীগুলোতে যদি পানির উচ্চতা বেড়ে যায় তাহলে আরো পাম্প বসাতে হবে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আমিরুল ইসলাম বলেন, ঢাকার মধ্যে আমাদের অংশের জলাবদ্ধতা এখন আগের চেয়ে অনেক কম। ড্রেন থেকে খাল আর খাল থেকে নদীতে পানি সরে যাবে। এই খাল এবং ড্রেনের বেশির ভাগই অন্য সংস্থার অধীনে। তবুও আমরা নিজ উদ্যোগে অনেক ড্রেন এবং খাল সংস্কার করে দিয়েছি। জলাবদ্ধতার বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘জলাবদ্ধতার মূল দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। আমরা খালগুলোকে আমাদের আওতায় দেওয়ার জন্য দাবি করেছিলাম। আমরা জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য উদ্যোগ নিয়েছি। এরই মধ্যে মিরপুরের সাংবাদিক খালের সমস্যা অনেকাংশে দূর করেছি। বিমানবন্দর থেকে কাওলা পর্যন্ত এলাকার খাল পুনঃ উদ্ধার করে সেই এলাকার সমস্যা দূর করেছি।’ সেখানে এখন পানি জমবে না।