বঙ্গবন্ধুর দর্শন ও আদর্শচর্চা :বেরিয়ে আসুক আনুষ্ঠানিকতার বৃত্ত থেকে

উন্নয়ন ডেস্ক –

বিশালতার ক্যানভাসে আঁকা বঙ্গবন্ধুর সারাটা জীবন। বাইগারের তীরে প্রকৃতির সঙ্গে খেলতে খেলতে, বিচিত্র পেশার মানুষের সঙ্গে মিশতে মিশতে তিনি হূদয়ে গ্রোথিত করেছিলেন সাধারণ মানুষের জীবনধারা, চাওয়া-পাওয়া আর ভাবানুভূতি।

দেখেছেন বেনিয়া ব্রিটিশ দখলদারদের দাপট-নিপীড়ন, খলরাজনীতির ধোঁয়াশা, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প, সামন্তবাদী জমিদারদের অত্যাচার, পাকিস্তানি সামরিক জান্তার শোষণ-অনাচার-বঞ্চনা আর ক্রুর রাজনীতির খেলা। সারা বংলার মাঠেঘাটে ঘুরে ঘুরে, আপামর জনগণের একজন হয়ে কাজ করে, বিপন্ন মানুষের পাশে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে, মতলববাজদের লাগিয়ে দেওয়া দাঙ্গায় আপন জীবন হুমকির মুখে ঠেলে দিয়ে, দাঙ্গাবাজদের রুখে দিয়ে আমজনতার সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন।

তিনি তার ‘অসম্ভব ঘ্রাণশক্তি’ দিয়ে জানাবোঝার চেষ্টা করেছেন এ দেশের মানুষকে। দীর্ঘ সময় নিয়ে তিনি তৈরি করেছিলেন অবশ্য প্রয়োজনীয় জাতীয়তাবোধ, যার গুরুত্ব ছিল সেই সময়ে অপরিসীম। মাঠকর্মী হিসেবে কাজ করে করে তিনি গড়ে তুলেছিলেন নিজস্ব চিন্তাভাবনার একটা বিশেষ জগত্, স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত আদর্শের ফল্গুধারা আর রাষ্ট্র পরিচালনার দর্শন। বিশাল হূদয়ের মানুষটির মনোজগতে বসবাস করত বাংলার সাড়ে ৭ কোটি মানুষের মঙ্গলচিন্তা, অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক শোষণ থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা, একটি স্বাধীন কল্যাণরাষ্ট্র সৃষ্টির পরিকল্পনা, হঠকারী রাজনীতির মূলোত্পাটনের সংকল্প আর দারিদ্র্যমুক্ত এক সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন।

নিজের মহত্ চরিত্রের মতোই তার দর্শনে ছিল সততা, ন্যায়নিষ্ঠতা, সুবিচার, সাম্যবাদিতা আর ধর্মনিরপেক্ষতার এক নিবিড় সংমিশ্রণ। প্রয়োগবাদী দর্শনে উদ্বুদ্ধ বঙ্গবন্ধুর দর্শন ছিল তাত্ত্বিকতাবর্জিত; ছিল সমাজের প্রয়োজনের নিরিখে প্রয়োগভিত্তিক।

কল্যাণমুখী দর্শনের ধারক বঙ্গবন্ধু লন্ডভন্ড ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে থেকেও স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পর পর দেশের হাল ধরে চেয়েছিলেন একটি শোষণহীন উন্নত-সমৃদ্ধ সমাজতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণ করবেন, অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলবেন, শোষিত-বঞ্চিত মানুষের জীবনে সমৃদ্ধি আনবেন, দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবেন, মানুষের মৌলিক অধিকার (সংবিধানে বর্ণিত) প্রতিষ্ঠা করে তাদের ভাগ্য বদলসহ জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করবেন এবং সর্বোপরি বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ির’ অপবাদ থেকে মুক্ত করে বিশ্বের মানচিত্রে মর্যাদার আসনে বসাবেন।

তার আদর্শের আর একটি বহুল আলোচিত দিক হলো, তিনি ছিলেন আপসহীন জননেতা; কখনো অন্যায়ের কাছে মাথা নোয়াতেন না। কখনো কাউকে মিথ্যা আশ্বাস দিতেন না কিংবা সাময়িক সুবিধাপ্রাপ্তির আশায় ব্যক্তিত্বহীন কথা বলতেন না। যেমনটি তিনি ভুট্টোর সঙ্গে পাকিস্তানের কারাগার থেকে শিহালা গেস্টহাউজে আসার পর আলাপচারিতায় দেখিয়েছেন।

ভুট্টো যখন শিহালা গেস্টহাউজে তাকে বলেন: ‘মুজিব, আপনি কথা দিন, আমরা একসঙ্গে থাকব।’ তখন বঙ্গবন্ধু কোনো তোয়াক্কা না করেই বলেছিলেন: ‘আগে আমি আমার মানুষের কাছে ফিরে যাই।’ এমনটি শুধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো অকুতোভয় মানুষই বলতে পারেন।

বাঙালির মুক্তির একক লক্ষ্যে তিনি ছিলেন অবিচল, নির্মোহ ও আপসহীন। শত প্রলোভনও তাকে তার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। শত্রুদের হাজারো চক্রান্তের জাল ছিন্ন করে তিনি লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে গিয়েছেন। বাঙালিলগ্নতা তাকে বাঙালির হূদয়ে স্থান করে দিয়েছে; তার রাজনৈতিক আদর্শের একটি বড় অংশ জুড়ে আছে বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রাম।

বাঙালির হূদয়মন জয় করে মাঠে-ময়দানে মানুষের নেতা হয়ে বঙ্গবন্ধু আমৃত্যু টিকিয়ে রেখেছিলেন তার রাজনৈতিক দর্শন। তার শিক্ষাদর্শনও ছিল অপূর্ব; ছিল না তাত্ত্বিকতার কচকচানি, ছিল বাস্তবতার পরশ। সবারই জানা প্রয়োজন, তার শিক্ষাদর্শনের মূল বিষয়বস্তু কী। তার শিক্ষাদর্শনের বহুমাত্রিকতা লুকিয়ে আছে তার সারা জীবন ও কর্মে।

ফিরোজ শাহের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলতে চাই, বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাদর্শনের মূল উপজীব্য ফুটে উঠেছে তার বিভিন্ন রচনায়, বক্তৃতায় আর নানাবিধ সিদ্ধান্তে :‘মানুষের মর্যাদা, আত্মমূল্যায়ন, দায়িত্ব-কর্তব্য ও শ্রদ্ধাবোধ, সৌজন্য, সত্যকে স্বীকার করা, ভুল স্বীকার করা, কর্তব্যবোধ, অন্যকে স্বীকৃতি দেওয়া, মানবিকতা ও মহানুববতা, প্রকৃতি ও পরিবেশ সচেতনতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া, সব প্রাণীর প্রতি মমত্ববোধ ইত্যাদি। …ভূপ্রকৃতি, জলবায়ু, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক-পরিচ্ছদ, সামাজিকতা, আচরণ—সবই বাংলাদেশে … ভিন্ন। বঙ্গবন্ধু এদেশের উপযোগী শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান চেয়েছেন—এটাই তার শ্রেষ্ঠ শিক্ষাদর্শন।’

বঙ্গবন্ধুর উন্নয়নদর্শন কখনো হবে না অপ্রাসঙ্গিক আজকের দিনেও। কারণ তার উন্নয়নদর্শনে নিহিত রয়েছে বাংলার মানুষের সার্বিক উন্নয়নের দিকনির্দেশনা। বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার পাতায় পাতায় বিধৃত রয়েছে তার উন্নয়নদর্শন। এতে রয়েছে মানুষের খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থানসহ সব মৌলিক চাহিদা পূরণের অঙ্গীকার। বহুমুখী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের মুখেও তিনি সঠিক নেতৃত্ব দিয়ে অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা করায় প্রবৃদ্ধির হার উন্নীত হয়েছিল ৭ শতাংশে।

গ্রামীণ অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনয়নের লক্ষ্যে তিনি অনেক যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। আজও আমরা দেখি, বঙ্গবন্ধুকন্যাকে ঘিরে যড়যন্ত্রের জাল, চারদিকে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, আগস্ট এলেই আমরা আতঙ্কিত বোধ করি। তার পরও মনে করি এবং দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, শত রকমের ষড়যন্ত্র আর কূটচালের মধ্যেও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও জীবনদর্শন থাকবে অম্লান এবং প্রাসঙ্গিক। তার কালজয়ী আদর্শ মলিন হবে না কখনো, থাকবে চিরকাল অপরাজেয়, বিরাজ করবে আমাদের জাতি হিসেবে এগিয়ে যাওয়ার আলোকবর্তিকা হিসেবে।

বাস্তববাদী জাতির পিতার জনমুখী অর্থনীতির দর্শনে ছিল অর্থনৈতিক শোষণমুক্ত, সাম্যতামণ্ডিত, বৈষম্যমুক্ত, কল্যাণমুখী, স্বয়ম্ভর সোনার বাংলা গড়ে তোলার প্রত্যয়। তার লালিত অর্থনীতির সেই দর্শনের পথ ধরেই তার সুযোগ্য উত্তরসূরি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনা অর্থনৈতিক অগ্রগতির ধারা অপূর্ব বিচক্ষণতায় বেগবান করেছেন, দেশকে উন্নত দেশের মর্যাদাপ্রাপ্তির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।

বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িকতাবাদ তথা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ দর্শনও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি সব সময় কামনা করতেন একটি ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ, অর্থাত্ এমন একটি দেশ, যে দেশে থাকবে না ধর্মের ভিত্তিতে বিভেদ-বিভাজন, সব নাগরিকই নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে স্বাধীনভাবে, তার ভাষায় ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’। ব্যক্তিগত জীবনে নিষ্ঠাবান মুসলিম এবং সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ দর্শন ছিল বাংলার মানুষের সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে তিনি কখনো ধর্মহীনতাকে বোঝাননি, যা নিন্দুকেরা সব সময় বলার চেষ্টা করেছে।

মানবতাবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য এ ধরনের দর্শন ছিল যুগোপযোগী। সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তি সব সময় সমাজে বিষবাষ্প ছড়ায় এবং রাষ্ট্রের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। বঙ্গবন্ধুর সেই ধর্মনিরপেক্ষতার নীতির কারণেই আজ বাংলাদেশ সারা বিশ্বে অসাম্প্রদায়িক, সভ্য দেশ হিসেবে বিশেষ মর্যাদার আসনে সমাসীন হতে সক্ষম হয়েছে।

আমরা কামনা করি, বঙ্গবন্ধুর আজীবন লালিত আদর্শ ও দর্শন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চর্চিত হোক হূদয়ের ভালোবাসা দিয়ে, মনের ভেতরে লালন করে, আপন কর্মকাণ্ডে প্রয়োগের মধ্য দিয়ে আর মঞ্জুরিত পুষ্পরেণু চারদিকে ছড়িয়ে দিয়ে। শোক দিবসে আর শোকাভীভূত হওয়া নয়, বঙ্গবন্ধুর দর্শন আর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে উঠুক দলমত-নির্বিশেষে সব বাঙালি, বাংলার জনগণ। চর্চিত হোক নির্মোহ চিত্তে তার দর্শন, প্রতিপালিত হোক জীবনের সর্বক্ষেত্রে তার আদর্শ। আমরা চাই, আনুষ্ঠানিকতার বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসুক বঙ্গবন্ধুর স্মরণ এবং আদর্শ ও দর্শনচর্চা; বরং প্রতিদিনের চর্চা থেকে, স্মরণ থেকে প্রতিষ্ঠিত হোক প্রতিটি মানুষের হূদয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের এক পরিপূর্ণ দেশ গড়ার প্রত্যয়।

বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত নাগরিকে ভরে উঠুক প্রতিটি ঘর, প্রতিটি পরিবার। স্বাধীনতাবিরোধী আর দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারীদের হাতে শহিদ হওয়ার পর সুদীর্ঘ সময় পার হলেও বাংলাদেশের জন্য সর্বদা প্রাসঙ্গিক বঙ্গবন্ধুর আদর্শ আর দর্শন হূদয় দিয়ে বুঝুক, অনুসরণ করুক সবাই। যার হাত ধরে জেগে উঠেছিল বাঙালি জাতি, দেশ আর দেশের মানুষকে অনেক বেশি ভালোবাসার কারণে স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে যে অবিসংবাদী সাহসী নেতাকে, তার অবর্তমানে তারই সুযোগ্য কন্যার দেখানো পথে চলুক সারা জাতি। তাতেই সম্মানিত হবেন ইতিহাসের মহানায়ক।