বাঁধ নির্মাণ না করে ব্লক দেখিয়েই অর্থ উত্তোলন

উন্নয়ন ডেস্ক –

দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার পাথারিয়া ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা ও অবকাঠামো রক্ষায় সুরমা নদীর তীরে বাঁধ নির্মাণের জন্য একটি প্রকল্প নিয়েছিল পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। জলবায়ু ফান্ডের টাকায় বাস্তবায়নাধীন এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল চলতি বছরের জুনে। মেয়াদ শেষ হলেও প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি কেবল ব্লক আনা পর্যন্ত। যদিও এসব ব্লক দেখিয়েই এরই মধ্যে টাকা তুলে নিয়েছেন ঠিকাদার। আর যেসব স্থাপনা রক্ষার জন্য এ প্রকল্প নেয়া হয়েছিল, সেগুলো রয়েছে এখন ভাঙনের মুখে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, প্রকল্পের কাজের জন্য সুরমা উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে ও পুরনো সুরমা নদীর দুই পাড়ে ফেলে রাখা আছে বেশির ভাগ ব্লক। ৭০-৮০ ভাগ ব্লকই বাঁধ তৈরির কাজে লাগানো হয়নি। এসব ব্লকে আকারেও রয়েছে ফাঁকি। বেশির ভাগ স্থানে জিও টেক্সটাইল ব্যাগ দেয়া হয়নি বলেও জানিয়েছে স্থানীয়রা। প্রকল্পের কাজে এ ধরনের গাফিলতির কারণে সুরমা উচ্চ বিদ্যালয় অ্যান্ড কলেজ, পাথারিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পাথারিয়া পোস্ট অফিস, পাথারিয়া ভূমি অফিস, পাথারিয়া কৃষি অফিস, পাথারিয়া বাজার ও স্থানীয় অনেকের বাড়িঘর ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে।

পাথারিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. মোস্তফা মিয়া এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, এখানকার বাজারসহ সরকারি একাধিক স্থাপনা পুরনো সুরমা নদীর ভাঙন থেকে রক্ষা করা যাবে না। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকজন নদীভাঙন হয়েছে এমন কয়েকটি স্থানে কিছু ব্লক ফেলা ছাড়া আর কোনো কাজই করছে না। পানি কখন বাড়বে সেজন্য অপেক্ষা করছিল তারা। নদীতে পানি বাড়া শুরু হলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রকল্প এলাকায় শ্রমিক কমিয়ে দিয়ে নামকাওয়াস্তে কাজ শুরু করেছিল। এখন পানিতে সব তলিয়ে যাওয়ায় তারা বলছে সব কাজই ঠিকভাবে হয়েছে। যদিও বাস্তবতা হচ্ছে প্রকল্পের ২০ ভাগ কাজই হয়নি। এখন শুনছি কাজ না করেই টাকা নিয়ে গেছে। তাহলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান কীভাবে টাকা দিল, তা বুঝতে পারছি না। এলাকার মানুষদের রক্ষা করতে হলে দ্রুত বাঁধ নির্মাণের কাজ সম্পন্ন করার দাবি জানান তিনি।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলায় পুরনো সুরমা নদীর ডান তীরে পাথারিয়ায় তীর সংরক্ষণ শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়নে রয়েছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড। এ প্রকল্পের পাথারিয়ায় ২২৩ মিটার তীর সংরক্ষণ প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয় ৩ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে শুরু হয়ে চলতি বছরের জুনের মধ্যে প্রকল্পটির কাজ শেষ করার কথা ছিল। প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে নেত্রকোনার একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, যার স্বত্বাধিকারী অসীম সিং।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, কর্তৃপক্ষের গাফিলতির কারণে প্রকল্পের ২০ শতাংশ কাজ শেষ হয়নি। যদিও পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীর দাবি প্রকল্পে ৮৫ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। এজন্য প্রকল্পের এ অংশের জন্য বরাদ্দকৃত অর্ধেক টাকা উত্তোলন করেছে। সব মিলিয়ে দুই দফায় ১ কোটি ৪৮ লাখ টাকা উত্তোলন করেছেন ঠিকাদার অসীম সিং।

বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে ঠিকাদার অসীম সিংয়ের সঙ্গে মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু কাজে নয়, প্রকল্পে ব্যবহূত উপকরণেও ফাঁকি দিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। প্রকল্প অনুযায়ী, ব্লকগুলো আকারে হবে দুই মাপের। একটি ব্লকের আকার থাকার কথা ছিল ৪০/৪০/২০ সেন্টিমিটার। এ আকারের ব্লক ব্যবহার হবে ১৯ হাজার ৪০০টি। আরেকটি ব্লকের আকার হবে ৩৫/৩৫/২০ সেন্টিমিটার, যার সংখ্যা ৩১ হাজার ২২৭। এছাড়া জিও টেক্সটাইল ব্যাগ ফেলার কথা রয়েছে। কিন্তু প্রকল্পের জন্য আনা এসব ব্লকের অধিকাংশই নিম্নমানের। তাছাড়া পরিমাপে রয়েছে বেশ ফাঁকি। এছাড়া জিও টেক্সটাইল ব্যবহারের কথা থাকলেও সেটি করা হয়নি। নির্ধারিত সময়ের দুই মাস অতিবাহিত হলেও কাজ শেষ না হওয়ায় এলাকাবাসীর মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। কর্তৃপক্ষের প্রতি নদীভাঙন রক্ষায় দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানিয়েছে এলাকাবাসী।

স্থানীয়রা জানান, প্রকল্পের শুরুতেই ব্লক নির্মাণ থেকে শুরু করে কাজে অনিয়ম করে আসছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি স্থাপনা এবং এলাকার বাড়িঘর রক্ষায় প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও এলাকাবাসীর কোনো উপকারে আসছে না। সরকারের টাকা লুটপাট করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি স্থাপনাসহ নদীভাঙন থেকে পাথারিয়া এলাকাকে রক্ষা করতে হলে দ্রুত নদীভাঙন প্রকল্পের কাজ শেষ করতে হবে। সেটি করতে না পারলে এবারের নদীভাঙনে সুরমা উচ্চ বিদ্যালয় এবং কলেজসহ সরকারি স্থাপনাগুলো নদীতে বিলীন হয়ে যাবে।

সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী (পওর-২) মো. সফিকুল ইসলাম এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, প্রকল্পের কাজ ৮৫ ভাগ হয়েছে। কিছু ব্লক লাগানো বাকি আছে। করোনা পরিস্থিতিতে শ্রমিকরা চলে যাওয়ার কারণে কাজের অগ্রগতি শতভাগ হয়নি। তবে শুধু ৫০ ভাগ ব্লক ডাম্পিং কাজ বাকি রয়েছে। আমরা প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য প্রস্তাব পাঠিয়েছি।

দেরির কারণে প্রকল্পের মাধ্যমে রক্ষাকৃত অবকাঠামো যদি না থাকে, তাহলে এ প্রকল্পের প্রয়োজন কী—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বর্ষার আগেই আমরা কাজ প্রায় শেষ করে নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু করোনার কারণে শ্রমিকদের কাজে লাগানো সম্ভব হয়নি। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমাদের কিছু করার ছিল না। এখন সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।