জুলাই ২৭, ২০২৪

আমাদের সম্পর্কে আরো জানুনঃ

মুদ্রানীতি মহামারিতে বেসরকারি ঋণ বাড়ানোর চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসছে

উন্নয়স ডেস্ক –

বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া মহামারি করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) বিপর্যস্ত অর্থনীতি। কমেছে আমদানি-রফতানি। থমকে আছে ব্যবসা-বাণিজ্য। কমে গেছে বিনিয়োগের গতি। অর্থনীতির এমন নাজুক পরিস্থিতিতে বেসরকারি ঋণ বাড়ানোর চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসছে ২০২০-২১ অর্থবছরের নতুন মুদ্রানীতি। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী সপ্তাহে এ মুদ্রানীতি ঘোষণা করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মহামারির কারণে এবার ভার্চুয়াল মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হবে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, করোনা মহামারির কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে আছে। পরিস্থিতি উত্তরণে প্রায় লাখ কোটি টাকার বিশেষ ঋণের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সরকার। প্যাকেজ বাস্তবায়নে প্রচলিত নীতিমালায় অনেক ছাড় ও শর্ত শিথিল করা হয়েছে। কিন্তু আগে থেকেই কমতে থাকা বেসরকারি ঋণের গতি লকডাউনে আরও নিচে নেমে গেছে। এ পরিস্থিতিতে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগমুখী করে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ানোই এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরপরও মুদ্রানীতিতে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোর নীতিতে একমত হয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিনির্ধারকরা। আসন্ন মুদ্রানীতিতে গতানুগতিক প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রার নির্ধারণ থেকে বেরিয়ে এসে উৎপাদন, কর্মসংস্থানমুখী, বাস্তবায়নযোগ্য মুদ্রানীতি ঘোষণার পরামর্শ নিয়েছেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জনের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতি বছর দুবার মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও প্রকাশ করত। ছয় মাস অন্তর এই মুদ্রানীতি একটি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে অর্থাৎ জুলাই মাসে এবং অন্য মুদ্রানীতি প্রকাশ করা হতো জানুয়ারি মাসে। কিন্তু গত বছর থেকে অর্থবছরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখার জন্য বছরে দুবার নয়; একবার মুদ্রানীতি ঘোষণার নিয়ম চালু করা হয়েছে।

দেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় মুদ্রানীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ ঋণ, মুদ্রা সরবরাহ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ, বৈদেশিক সম্পদ কতটুকু বাড়বে বা কমবে এর একটি পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়।

মহামারির এ সময়ে গতানুগতিক প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের মুদ্রানীতি ঘোষণা থেকে বেরিয়ে আসার পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘এবার মুদ্রানীতি সংকোচন নয়, সম্প্রসারণমূলক হবে। তবে গতানুগতিক ধারা যেমন প্রবৃদ্ধি বাড়ানো, মূল্যস্ফীতি কমানো-এই ধরনের লক্ষ্যমাত্রা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।’

‘এখন আমাদের মুদ্রানীতির মূল কাজ হওয়া উচিত কীভাবে অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করা যায়। এই সংকট থেকে বেরিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া যায় এ বিষয়ের ওপর। এজন্য কয়েকটি খাতকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। এর মধ্যে অন্যতম হলো কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, ছোট ছোট ব্যবসা ও আমাদের দেশীয় উৎপাদনমুখী প্রতিষ্ঠান। যাদের বেশি গুরুত্ব দেয়া দরকার। এতে আমাদের উৎপাদন বাড়বে, অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। পাশাপাশি মূল্যস্ফীতিও কমে যাবে’, বলেন সালেহ উদ্দিন আহমেদ।

তিনি বলেন, ‘আমাদের রফতানি বহুমুখীকরণের বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। শুধু পোশাক খাতের ওপর নির্ভর হলে চলবে না। সম্প্রতি পোশাক খাতে বেশকিছু প্রণোদনা দেয়া হয়েছে। আরও দেয়ার চিন্তাভাবনা চলছে। এটা কেন দিচ্ছে জানি না। কারণ অন্য খাতগুলোকে যদি রফতানিমুখী না করতে পারি তাহলে আমাদের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়।’

অগ্রাধিকার খাতগুলোর মধ্যে কৃষিখাতকে আরও গুরুত্ব দিতে হবে জানিয়ে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘কৃষিখাতে ঋণ বাড়াতে ব্যাংকগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে যেন তারা ঋণ দিতে বাধ্য হয়। এছাড়া আমাদের যারা বেকার হয়ে যাচ্ছেন; গরিব, সাধারণ মানুষ রয়েছেন তাদের সহযোগিতার উদ্যোগ নিতে হবে যেন তারা নিজে নিজে আত্মকর্মসংস্থানে যেতে পারেন। ব্যাংকগুলো এক্ষেত্রে সরাসরি এগিয়ে আসবে না। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত একটা বিশেষ তহবিল গঠন করে এদেরকে সহযোগিতা করা।’

শুধু লক্ষ্যমাত্রানির্ভর মুদ্রানীতিতে না থেকে কীভাবে তা বাস্তবায়ন করা যায়, সেই বিষয়ের ওপর জোর দেয়ার পরামর্শ দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এ গভর্নর বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংকে নির্ধারিত লক্ষ্য দিয়ে দিবে এবং তারা তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করছে কি-না তা তদারকি করবে।’

ছয় মাস পরপর মুদ্রানীতি না দিয়ে এক বছর পর দেয়ার বিষয়টির সমালোচনা করে সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এক বছরে দেশের অর্থনীতিতে অনেক পরিবর্তন আসে। তাই মুদ্রানীতিকে ছয় মাস পরপর হওয়া উচিত। কিন্তু তা এক বছর করার মানে হচ্ছে তারা এটা করে বসে থাকবে আর মাঝেমধ্যে সার্কুলার দিয়ে তা সংশোধন করবে-এটা আসলে ঠিক নয়।’

সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরের (২০১৯-২০) ১১ মাসে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ হয়েছে ৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ। যেখানে মুদ্রানীতিতে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। তবে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমলেও বেড়েছে সরকারের ঋণ। মুদ্রানীতিতে সরকারের ঋণ প্রবাহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ। ১১ মাসে সরকারের ঋণপ্রবাহ লক্ষ্যমাত্রা থেকে প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে হয়েছে ৪৩ দশমিক ৪৭ শতাংশ। অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রবাহের লক্ষ্যমাত্রাও অর্জন হয়নি বিদায়ী মুদ্রানীতিতে। অভ্যন্তরীণ ঋণপ্রবাহ ১৫ দশমিক ৯ শতাংশের বিপরীতে ১১ মাসে অর্জিত হয়েছে ১১ দশমিক ৭৭ শতাংশ।

এদিকে তারল্য সংকট মোকাবিলা ও টাকার প্রবাহ বাড়াতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আমানতের বিপরীতে বাধ্যতামূলক নগদ জমার হার দুই দফায় দেড় শতাংশ কমিয়েছে। এতে করে ব্যাংকগুলোতে বাড়তি ২০ হাজার কোটি টাকা নগদ তারল্যের জোগান হয়েছে। পাশাপাশি করোনায় আর্থিক ক্ষতি মোকাবিলায় ঘোষিত প্যাকেজ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ব্যাংকগুলোর হাতে থাকা ট্রেজারি বিল ও বন্ড বন্ধক রেখে এক বছরের জন্য ধার নেয়ার সুযোগ করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর ঋণসীমা (এডিআর) বাড়িয়ে ৮৫ শতাংশ থেকে ৮৭ শতাংশ করা হয়েছে।

কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের ২০ হাজার কোটি টাকা এবং শিল্প ও সেবা খাতের ৩০ হাজার কোটি টাকার এ প্যাকেজ বাস্তবায়নে তারল্য অর্থ সরবরাহ নিশ্চিতে প্যাকেজের অর্ধেক অর্থাৎ ২৫ হাজার কোটি টাকার তহবিল জোগানের ঘোষণা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

Facebook
Twitter
LinkedIn
Pinterest
Reddit