রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের প্রধান সমস্যা খেলাপি ঋণ

এস এম ইদ্রিস: রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের লাগাম কোন ভাবেই টেনে ধরা সম্ভব হচ্ছেনা। দিন দিন বেড়েই চলছে খেলাপির অংক। পুঞ্জিভূত খেলাপি ঋণের টাকা পরিশোধে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছেনা খেলাপিরা। মূলত এ কারণেই অর্থ আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না। পাশাপাশি ব্যাংক খাতে গুণগত মানের ঋণ বৃদ্ধিতে শ্লথগতি বিরাজ করছে। বিভিন্ন ধরনের অস্বাভাবিক ছাড় দিয়েও খেলাপি ঋণ নিয়মিত রাখা যাচ্ছে না। খেলাপিরা ছাড় নিয়ে আবার খেলাপি হচ্ছে। আসলে আমাদের অধিকাংশই ইচ্ছাকৃত খেলাপি। এদের টাকা অন্য খাতে চলে গেছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো নিজেরাই এই সমস্যাগুলো শনাক্ত করে পৃথকভাবে তুলে ধরেছে বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিপত্রে (এপিএ)।
এছাড়া ব্যাংক খাতে অবলোপন করা ঋণ থেকে আদায় কম এবং মামলাজনিত কারণেও ঋণের অর্থ আদায় বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরেই বহুজাতিক দাতা সংস্থা, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্ব ব্যাংক তাদের দেয়া ঋণের শর্ত হিসাবে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের অঙ্ক দ্রুত কমাতে বলছে। আগামী ২০২৬ সালের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশ ও বেসরকারি খাতের খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনতে বলেছে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর এপিএ নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ব্যাংকগুলো সমস্যার পাশাপাশি আগামী দিনগুলোতে চ্যালেঞ্জের কথা তুলে ধরেছে। সেখানে বলা হয়, খেলাপি সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা, টাকা আদায়ে চাপ দেওয়া হলে রিট মামলা দায়ের করার প্রবণতা, রিট ভ্যাকেটে দীর্ঘসূত্রতার কারণে ঋণ আদায় কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। যা ব্যাংকিং খাতে বড় সমস্যা হিসাবে মনে করা হচ্ছে। এছাড়া অটোমেশনের কারণে হ্যাকিং ঝুঁকি বৃদ্ধি ও প্রযুক্তি ব্যবহারে সীমাবদ্ধতাকে চিহ্নিত করা হয়। ব্যাংকিং খাতের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সুশাসন নিশ্চিত করতে প্রতি অর্থবছরের জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি (এপিএ) স্বাক্ষর করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাথে। চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরের জন্য ইতোমধ্যে সোনালী, অগ্রণী, রূপালী ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এই চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। চারটি ব্যাংক চলতি অর্থবছরে মোট খেলাপি ঋণ থেকে ১ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা আদায়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
এপিএতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো প্রতি অর্থবছরের কর্মকাণ্ডের একটি পরিকল্পনা বা রূপরেখা দেয়। পরে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সাথে কর্মসম্পাদন নামে প্রতিটি ব্যাংকের চুক্তি হয়। নতুন অর্থবছরের রূপরেখায় ব্যাংকগুলো তাদের প্রধান সমস্যাগুলো তুলে ধরে। পাশাপাশি খেলাপি এবং অবলোপন ঋণ থেকে কত টাকা আদায় করবে, মোট খেলাপি ঋণের অঙ্ক, লোকসানি শাখা কমিয়ে আনাসহ নানা প্রতিশ্রুতি থাকে।
উল্লেখ্য যে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক সমূহের বড় বড় অধিকাংশ ঋণ রাজনৈতিক বিবেচনায় দেওয়া। যার কারণে ঋণ বিতরণের সময় সঠিকভাবে ঋণ সিলেকশন, গ্রাহক সিলেকশন এবং জামানতের ক্ষেত্রে শুরু থেকেই বড় ধরনের দুর্বলতা থেকে যায়। এছাড়াও যেসব মেশিনারিজ আনা হয় তার প্রায় সবই নিম্নমানের, যে কারণে কার্যত বেশিরভাগ প্রজেক্ট চালু হয় না। টাকা চলে যায় অন্যান্য খাতে। ফলে এক পর্যায়ে ঋণ গুলো খেলাপি হয়ে যায়। আর টাকা আদায়ের ক্ষেত্রে ব্যাংক কর্মকর্তারাও ভূমিকা নিতে পারে না। শুরু হয় রি সিডিউলিং, রি স্ট্রাকচারিং, ২%, সুদ মওকু ইত্যাদি সুযোগ প্রদানের মাধ্যমে খেলাপি আড়াল করার কৌশল। আবার এই সুযোগে পর্ষদ সদস্যরা ও অনেক ব্যাংক কর্মকর্তাও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন।
এসব বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট, সিপিডি, টিআইবি ও সুজন সহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর সংস্কারের জন্য বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে আসছে। কিন্তু বাস্তবে কিছুই হচ্ছে না।বর্তমান প্রেক্ষাপটে খেলাপি ঋণ যে ব্যাংকিং খাতের বড় সমস্যা তা সকল পক্ষই এখন স্বীকার করে নিয়েছে। এর ফলোআপ হিসাবে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে একটি সমস্যা হচ্ছে-খেলাপিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিলে তারা উচ্চ আদালতে গিয়ে একটি রিট করে স্টে-অর্ডার নিয়ে আসে। এই সমস্যারও সমাধান করতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যমতে, গত মার্চ পর্যন্ত মোট খেলাপি ঋণের অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। শুধু ৩ মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) বেড়েছে ১০ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা। আর বিগত এক বছরে বেড়েছে খেলাপি ঋণ ১৯ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত খেলাপি ঋণের পরিসংখ্যানের ব্যাপারে আবার অর্থনীতিবিদদের দ্বিমত দেখা যায়। আসলে সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়াও কঠিন।
এপিএতে রাষ্ট্রায়ত্ত শীর্ষ সোনালী ব্যাংক খেলাপি ঋণের অঙ্ক গত অর্থবছরের ১১ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা থেকে চলতি অর্থবছরে ১১ হাজার ৫০০ কোটিতে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আর শ্রেণিকৃত এবং অবলোপনকৃত ঋণ থেকে একই সময়ে ৫৬৫ কোটি টাকা আদায় করবে বলে জানিয়েছে। এ বছর ২৮ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। একইভাবে অগ্রণী ব্যাংক গত অর্থবছরের ১৪ হাজার ৮১০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণের অঙ্ক থেকে চলতি অর্থবছরে ১৪ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনার পরিকল্পনা নিয়েছে। এ সময় শ্রেণিকৃত ঋণ থেকে ৭০০ কোটি টাকা এবং অবলোপনকৃত ঋণ থেকে ৫০ কোটি টাকা আদায়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। পাশাপাশি রূপালী ব্যাংক বলেছে, গত অর্থবছরের শ্রেণিকৃত ঋণ ৯ হাজার ২৪০ কোটি থেকে ৯ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হবে। একই সময়ে ৪৫০ কোটি টাকা আদায় করা হবে ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে। আর অবলোপনকৃত ঋণ থেকে আদায় করবে ১০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক প্রতিশ্রুতি দিয়েছে খেলাপি ঋণ ৯৫০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হবে।

এ ব্যাপারে অর্থ বিভাগের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, শ্রেণিকৃত ঋণ থেকে অর্থ আদায়ের যে প্রতিশ্রুতি ব্যাংকগুলো দিয়েছে, বিষয়টি ভালো। কিন্তু ব্যাংকগুলো ঋণ আদায়ের দায়িত্বরত কর্মকর্তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে কিনা তা ‘ব্যাংক টু ব্যাংক’ ধরে মনিটরিং করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের পরিচালকদের ভালো ও দক্ষ কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দিতে হবে। আর যদি এক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়, অবশ্যই ওই কর্মকর্তাকে সেখান থেকে সরিয়ে দিতে হবে।

এপিএ নথিতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো বলেছে, ব্যাংকের ভিত্তি দুর্বল। এক্ষেত্রে মুনাফা অর্জনের মাধ্যমে সেটি শক্তিশালী করা হবে। সেখানে আরও বলা হয়, কোভিড-১৯ এর প্রভাব ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে ব্যাংকিং খাতে ঋণ ও অগ্রিম থেকে সুদ আদায়, ফি ও কমিশন থেকে আয় কমছে। এছাড়া ব্যাংকের সীমিত অপরাশেন এবং ঋণ ও আমানতের স্থিতি তুলনামূলক কম। এছাড়া খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ব্যাসেল-৩-এর সাথে সংগতি রেখে মূলধন সংরক্ষণ পর্যাপ্তভাবে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। প্রভিশন (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) ঘাটতি বেড়েই চলছে। সেখানে আরও বলা হয়, ঋণখেলাপিরা টাকা পরিশোধ করতে অনীহা দেখাচ্ছে। টাকা না দিয়ে উলটো মন্দ গ্রাহকরা আদালতে রিট মামলা দায়ের করে দিচ্ছে। এসব মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতায় পড়ে যাচ্ছে ব্যাংকগুলো। পাশাপাশি রিট নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘সিআইবি লিস্টে’ থাকার কারণে ঋণ আদায় কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে ব্যাংকগুলোর মূলধন পর্যাপ্ত হারে সংরক্ষণ ও শ্রেণিকৃত ঋণ আদায় এক ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন খেলাপি ঋণ সমস্যা সমাধানে ব্যাংক গুলোর শীর্ষ নেতৃত্ব এমডি ও ব্যবস্থাপনায় যারা আছেন তাদেরই দায়িত্ব নিতে হবে। এছাড়া খেলাপি ঋণ কমানো ও কর্পোরেট সুশাসন নিশ্চিত করতে ব্যাংকিং সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন বলেও তিনি উল্লেখ করেন। বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যায় খেলাপিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিলে তারা উচ্চ আদালতে গিয়ে একটা রিট করে স্টে- অর্ডার নিয়ে আসে। এই সমস্যাগুলোর সমাধান করতে হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ ব্যাংক সম্মিলিতভাবে প্রধান বিচারপতির সাথে দেখা করে সমস্যাগুলো কিভাবে দূর করা যায় সে চেষ্টা চালাতে পারেন। দুর্নীতিবাজ খেলাপিদের যেমন তালিকা প্রকাশ করা প্রয়োজন ঠিক তেমনি এসব ঋণ খেলাপিদের সাথে যে সকল দুর্নীতি প্রবণ ব্যাংক কর্মকর্তা সম্পৃক্ত তাদেরও তালিকা প্রকাশ করা উচিত। সবচেয়ে প্রধান যে বিষয়টি তা হচ্ছে অবশ্যই রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও অঙ্গীকার থাকতে হবে। অন্যথায় দুর্বৃত্তরা কোন না কোনভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে এ সকল খেলাপি ঋণ প্রলম্বিত করতেই থাকবে