উন্নয়ন ডেস্ক –
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন প্রকল্পে ব্যয় বাড়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর (ডিপিএইচই) ব্যয় বাড়ানোর যৌক্তিকতা তুলে ধরলেও কমিশন তাতে বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়েছে। ব্যয় বৃদ্ধির এ পরিমাণ ৩৮০ কোটি টাকার বেশি। ‘কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন কার্যক্রমে জরুরি সহায়তা’ প্রকল্পের আওতায় এমন ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে ডিপিএইচই।
সংশোধিত প্রকল্পের প্রস্তাবনা এরই মধ্যে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগে পাঠানো হয়েছে। এটিসহ সামগ্রিকভাবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন প্রকল্পে ব্যয় ৫৮৫ কোটি ৩৩ লাখ টাকা থেকে বেড়ে ৯৬৬ কোটি ২৮ লাখ ৬৯ টাকা হচ্ছে। ফলে মূল প্রকল্প থেকে সংশোধিত প্রকল্পে ব্যয় বাড়ছে ৬৫ শতাংশ। টাকার অঙ্কে যা ৩৮০ কোটি ৯৫ লাখ টাকা।
প্রকল্পটির ব্যয় বাড়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন। সারফেস ওয়াটার রিজার্ভার বাবদ ১০০ কোটি ৯৬ লাখ টাকার পরিবর্তে ১৫৬ কোটি ৭৬ লাখ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। সাপ্লাই ও সার্ভিস বাবদ ১০ লাখ ১৩ হাজার টাকা এবং পরামর্শক বাবদ ২৬ কোটি ৭৬ লাখ ৩৪ হাজার টাকা বাড়ানোর বিষয়েও প্রশ্ন তুলেছে কমিশন। ওয়াটার উইথ প্রোডাকশন টিউবওয়েলের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এ মুহূর্তে এই কাজ উন্নয়ন বাবদ ব্যয় ২৩ কোটি ৫০ লাখ টাকার প্রস্তাবের যৌক্তিকতা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন।
সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) মো. মামুন-আল-রশীদের সভাপতিত্বে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় এসব প্রস্তাবনা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। এমনকি কিছু কিছু আইটেমের বাড়তি ব্যয়ের প্রস্তাবের ব্যাখ্যাও চাওয়া হয়েছে। এসব বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যা না পেলে প্রকল্পটির ব্যয় বাড়ানো হবে না বলে জানিয়েছে কমিশন।
পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) মো. মামুন-আল-রশীদ মিডিয়াকে বলেন, ইন্ট্রিগ্রেটেড ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট ও রিচার্জ রিকভারি ফ্যাসিলিটির জন্য নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের লক্ষ্যে ব্যয় ২২ কোটি টাকার পরিবর্তে চাওয়া হয়েছে ৯৫ কোটি টাকা। অনেক সময় বিদ্যুতের ঝামেলা হয় বলে সোলার ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। এ ব্যাপারে কারিগরি কমিটি থেকে প্রত্যয়ন চাওয়া হয়েছে। আমাদের সুনির্দিষ্টভাবে বলতে হবে, এই সোলার কতদিন টেকসই হবে। কেনার পরে হয়তো ছয় মাস পরে নষ্ট হলো, তা হবে না। আমাদের প্রত্যয়ন দিতে হবে।
‘প্রকল্পের আওতায় নতুন কিছু আইটেমের কথা বলা হয়েছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ডিসি, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাজ করেন এমন ব্যক্তিদের মতামত চেয়েছি। কিছু কিছু ব্যয় কমানোর কথাও বলা হয়েছে। আমরা যেভাবে বলেছি, সেভাবে প্রকল্পটি যদি আমাদের কাছে পাঠায় তাহলে পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য ফরওয়ার্ড করবো। না হলে করবো না।’
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মূল প্রকল্পের ব্যয় ছিল ৫৮৫ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি অর্থায়ন ছিল ২২৪ কোটি ৫৯ লাখ এবং ঋণ ৩৬০ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। নতুন করে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৯৬৬ কোটি ২৮ লাখ টাকায়। মোট ব্যয় মেটানোর ক্ষেত্রে সরকারি অর্থায়ন ৩১৭ কোটি ২৪ লাখ এবং বৈদেশিক ঋণ ধরা হয়েছে ৬৪৯ কোটি ৪ লাখ টাকা। ফলে প্রকল্পটি সংশোধনের কারণে বৈদেশিক ঋণ দ্বিগুণ হচ্ছে।
প্রকল্পের পরিচালক মো. আব্দুল হালিম খান এ বিষয়ে জাগো নিউজকে বলেন, প্রকল্প এলাকার ডিমান্ড বেড়ে গেছে। এসব কারণেই মূলত ব্যয় বেড়েছে। কথার কথা, আগে যেখানে ১০ জনকে খাওয়ানো হতো, এখন সেটা বেড়ে ১০০ জন হয়েছে।
পানি ব্যবহারের প্রযুক্তিতে ২২ থেকে ৯৫ কোটি টাকা ব্যয় বৃদ্ধি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, লবণ পানি খাওয়ার উপযোগী করা হবে দেশি ও বিদেশি প্রযুক্তি ব্যবহার করে। পানির চাহিদাও বেড়েছে। এসব কারণেই মূলত বাড়তি ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে।
মূল প্রকল্পটি ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন নাগাদ সমাপ্ত হওয়ার সময় নির্ধারিত ছিল। কিন্তু এই মেয়াদেও প্রকল্পের কাজ অসমাপ্ত রয়ে যায়। ফলে ব্যয় বৃদ্ধি ব্যতিরেকে প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর অর্থাৎ জুন ২০২২ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এই মেয়াদেও প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত হচ্ছে না। ফলে প্রকল্পের মেয়াদ জুন ২০২৫ সাল নাগাদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রকল্পে ঋণদানকারী সংস্থা এডিবি। সময় বাড়ানোর বিষয়টি এডিবির উপর নির্ভর করে। সেই ধারাবাহিকতায় মার্চ ২০২২ পর্যন্ত একবার একবছর সময় বাড়িয়েছে এডিবি। এডিবির তরফ থেকে আরও একবছর অর্থাৎ মার্চ ২০২৩ পর্যন্ত সময় বর্ধিতকরণের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। এক্ষেত্রে সময় ২০২৫ পর্যন্ত বাড়ানোর যৌক্তিকতা নিয়ে সভায় আলোচনা হয়। প্রকল্পের আউটপুট নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
জুন ২০২১ পর্যন্ত প্রকল্পের ব্যয় হয়েছে ২৪৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা এবং বাস্তব অগ্রগতি ৬৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ।
প্রকল্প সংশোধনের কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, প্রথমেই প্রকল্প পরিচালক নিয়োগে বিলম্ব হয়েছে। প্রকল্পের শুরুতে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ মেলেনি। এছাড়া কতিপয় অঙ্গের ব্যয় বাড়া, যেমন- ওয়াটার ক্যারিয়ার, ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট ইক্যুইপমেন্ট, পাইপড ওয়াটার সাপ্লাই ইত্যাদি। নতুন কিছু কাজ বা ইক্যুইপমেন্ট যুক্ত হয়েছে। যেমন- ৪০টি মিনি পাইপড ওয়াটার সাপ্লাই, ইন্টিগ্রেটেড ওয়াশ ফ্যাসিলিটিস, সিভিল ওয়ার্ক ইম্প্রুভমেন্ট ইত্যাদি। কোভিড-১৯ এর কারণে প্রকল্পের কাজ যথাসময়ে করা সম্ভব হয়নি।
প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে মিয়ানমারের যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী আছে, এসব শরণার্থী বর্তমানে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার বিভিন্ন ক্যাম্পে বসবাস করছে। কিন্তু ওই এলাকায় এসব লোকজনের জন্য পর্যাপ্ত স্যানিটেশন ও পানি সরবরাহের ব্যবস্থা নেই। তাই নিরাপদ পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা স্থাপনের জন্য পাইপড ওয়াটার সাপ্লাই সিস্টেম উইথ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট, রিজার্ভার ও ওয়াটার ক্যারিয়ার এগ্রিমেন্ট, স্যানিটেশন সুবিধাদি নির্মাণ-স্থাপনের জন্য প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে।
প্রকল্পের সামগ্রিক উদ্দেশ্য হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিরাপদ পানি সরবরাহ এবং স্যানিটেশন সুবিধা বাড়ানোর মাধ্যমে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় ৩২টি ক্যাম্পে শরণার্থী হিসেবে বর্তমানে বসবাসরত মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মানুষের স্বাস্থ্য ও জীবনমান উন্নত করা।