অনিশ্চয়তায় ৪ লাখ কর্মী, ক্ষতি প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা

উন্নয়ন ডেস্ক –

টাঙ্গুয়ার হাওরে এখন পর্যটনের ভরা মৌসুম। বছরের এই সময়ে সেখানে খুব ব্যস্ত সময় কাটে ট্যুর অপারেটর প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের। কিন্তু কভিড-১৯-এর প্রভাবে এবারের চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত। পর্যটকের আনাগোনা না থাকায় দিনের পর দিন ঘাটে বাঁধা পড়ে আছে খালি নৌকা। একই অবস্থা পাহাড়ের পর্যটন কেন্দ্রগুলোরও। চার মাস ধরে বন্ধ রয়েছে সাজেক ও শ্রীমঙ্গলের রিসোর্টগুলো। পর্যটকশূন্য পড়ে আছে কক্সবাজার, কুয়াকাটা ও পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতও। পর্যটনের এ স্থবিরতায় বেড়ে চলেছে আর্থিক ক্ষতি, কর্মহীন হয়ে পড়েছে এ খাতের ওপর নির্ভরশীল কয়েক লাখ মানুষ।

কভিড-১৯-এর প্রভাবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর পর্যটন খাতের সম্ভাব্য ক্ষতির একটি হিসাব করেছে বিশ্বব্যাংক। ‘কভিড-১৯ অ্যান্ড ট্যুরিজম ইন সাউথ এশিয়া: অপরচুনিটি’স ফর সাসটেইনেবল রিজিওনাল আউটকামস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে সংস্থাটি জানিয়েছে, করোনার কারণে পর্যটন খাতের স্থবিরতায় বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) সম্ভাব্য ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা (২০৩ কোটি ডলার)। এ খাতে চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার মানুষ।

দেশের পর্যটনের ভরা মৌসুম হিসেবে বিবেচনা করা হয় অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়কে। বেড়াতে পছন্দ করেন এমন মানুষ এ সময় বেরিয়ে পড়েন। কেউ দেশে আবার কেউ দেশের বাইরে ঘুরতে যান। বিদেশ থেকেও অনেকে বেড়াতে আসেন বাংলাদেশে। কিন্তু মরণঘাতী ভাইরাস করোনার আঘাতে এবার ভ্রমণ পরিকল্পনা বাদ দিয়েছে সবাই। ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর বন্ধ হয়ে যায় যোগাযোগ ব্যবস্থা। তালা পড়ে হোটেল-মোটেলে। শূন্য পড়ে থাকে ভ্রমণকেন্দ্রগুলো।

টাঙ্গুয়ার হাওরে বছরের এই সময়ে নিজস্ব বড় আকারের নৌকা দিয়ে পর্যটক আনা-নেয়া করে ট্যুর অপারেটর প্রতিষ্ঠান ট্যুরগ্রুপ বিডি। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইমরানুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, অন্যান্য বছর এ সময়ে পর্যটকদের আনাগোনায় কর্মব্যস্ত সময় কাটে ট্যুরগ্রুপের কর্মীদের। কিন্তু এ বছর নৌকা এখনো ঘাটেই বাঁধা। একই অবস্থা আমাদের আরো পাঁচটি উদ্যোগের। করোনার কারণে গত চার মাসে সাজেক, শ্রীমঙ্গলের রিসোর্টগুলোর তালাও খুলতে পারিনি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে অর্থনৈতিক কর্মচাঞ্চল্য ফিরে এলেও কবে নাগাদ পর্যটনের এসব প্রতিষ্ঠান চালু করা যাবে, এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো নির্দেশনা পাওয়া যায়নি।

করোনার প্রভাবে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত খাতের একটি হচ্ছে পর্যটন। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, করোনাকালে দক্ষিণ এশিয়ায় পর্যটনসংশ্লিষ্ট ৪ কোটি ৭৭ লাখ মানুষ কর্মহীন হয়েছে, যার একটি বড় অংশই নারী। আর দেশগুলোর জিডিপিতে ক্ষতি হয়েছে ৫ হাজার কোটি ডলার। পর্যটনে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে মালদ্বীপের। কেননা ২০১৯ সালে দেশটির জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদান ছিল ৫৬ দশমিক ৬ শতাংশ এবং কর্মসংস্থানে অবদান ছিল ৫৯ দশমিক ৬ শতাংশ। মালদ্বীপের মতো পর্যটননির্ভর না হলেও করোনায় উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হয়েছে শ্রীলংকা, ভুটান, ভারত, নেপাল ও পাকিস্তানের।

ট্যুরিজম বোর্ডের হিসাবে করোনার প্রভাবে এখন পর্যন্ত ১৩ হাজার কোটি টাকার মতো ক্ষতির তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মহিবুল হক। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, পর্যটনে যে ক্ষতি হচ্ছে বা হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যাতে আর না হয় সেজন্য আমরা ওপেন করার ব্যবস্থা করছি। হোটেল-মোটেল রিসোর্টগুলো যাতে এ করোনার ভেতরেও খুলে দেয়া যায়, সেই জন্য একটি নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে। শিগগিরই এটি প্রকাশ করা হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে হোটেল-মোটেল-বিনোদন কেন্দ্রগুলো কীভাবে খুলবে সেখানে তার নির্দেশনা দেয়া আছে। আর যারা এসব জায়গায় যাবেন তাদের স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে দায়িত্ব-কর্তব্য কী হবে, সেটাও ওখানে বলা আছে। কারণ এটা তো টু-ওয়ে ট্রাফিক, একজনের প্রতিপালন করলে হবে না।

করোনার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পর্যটন খাতেও প্রণোদনা ঘোষণা করেছে সরকার। কিন্তু বেশির ভাগই এই সুযোগটা নিতে পারছে না। কারণ সাড়ে ৫ শতাংশ সুদহারে যে ঋণের সুযোগ দেয়া হয়েছে তা মর্টগেজ দিয়ে নিতে হবে। যাদের এ ধরনের কিছু নেই তারা এই সুযোগ নিতে পারছে না। এটাও একটা সমস্যা বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ট্যুর অপারেটরদের সংগঠন টোয়াবের পরিচালক মোহাম্মদ এ রউফ বলেন, হোটেল-মোটেল-পর্যটন স্পট সব বন্ধ। কবে নাগাদ এসব চালু হবে এ বিষয়ে কোনো দিকনির্দেশনা আমাদের দেয়া হয়নি। আমাদের সংগঠনে সাত শতাধিক সদস্য রয়েছে। সবার ব্যবসার অবস্থা খারাপ। সরকারের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এ খাতের ঘুরে দাঁড়ানো প্রায় অসম্ভব।

পর্যটন খাতসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ২০১৯ সালে দেশের স্থানীয় পর্যটকের সংখ্যা ছিল প্রায় ১ কোটি ২০ লাখের মতো। আর বিদেশী পর্যটক এসেছিলেন ৭ থেকে ৮ লাখের মতো। জিডিপিতে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ অবদান ছিল পর্যটন খাতের। কর্মসংস্থান তৈরির ক্ষেত্রেও এ খাতের অবদান ছিল ২ শতাংশ হারে। সরকার ট্যুরিজম খাত নিয়ে ৫০ হাজার কোটি টাকার মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল। পর্যটক আকর্ষণে দেশের বিভিন্ন স্থানে ইকো ট্যুরিজম পার্ক স্থাপনের কাজও চলছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে ৫০ লাখ বিদেশী পর্যটক আকর্ষণ এবং স্থানীয় পর্যটকের সংখ্যা চার কোটিতে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। তবে সব পরিকল্পনাই স্তিমিত হয়ে পড়েছে করোনার প্রভাবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভুঁইয়া বলেন, পর্যটন খাতে বড় অংকের বিনিয়োগ করেছেন ব্যবসায়ীরা। এ খাত কর্মসংস্থানের প্রচুর সুযোগও তৈরি করেছে। এখন পর্যটনের ভরা মৌসুমে সবাই বসে রয়েছেন। এ খাতকে পুনরুজ্জীবিত করতে হলে সরকারের বড় ধরনের নীতিসহায়তা দরকার।

তিনি বলেন, করোনার প্রভাবে পর্যটন খাতের সমস্যা নিরসনে সরকার ‘ট্যুরিজম ম্যানেজমেন্ট’ কমিটি গঠন করেছে। এ কমিটির কাজ হলো এই খাতকে চাঙ্গা করতে যেসব উদ্যেগ নেয়া প্রয়োজন সে বিষয়ে পরামর্শ দেয়া। পর্যটন খাতের কর্মীদের আবার কাজে ফেরানোর জন্যও সরকার একটি লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে। এখন এসব উদ্যোগ সব যাতে একসঙ্গে কাজ করে সে বিষয়ে নজর রাখতে হবে। ট্যুর অপারেটর, ক্ষুদ্র বা মাঝারি হোটেল মালিক এদের চিহ্নিত করে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যাংক থেকে স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থার উদ্যোগ নিতে হবে। পর্যটন খাতে যারা চাকরি করেন, তাদের চাকরি যাতে না যায়, সে বিষয়েও সরকারের সুদৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন।