অমলাশঙ্কর: এক কিংবদন্তির বিদায়

উন্নয়ন ডেস্ক –

১০১ বছর আগের অবিভক্ত বাংলার যশোরের বাটাজোর। অক্ষয় কুমার নন্দীর মেয়ে অমলা, কিংবদন্তি অমলাশঙ্করের মৃত্যু যেন ইতিহাসের একটা সুতো ছিঁড়ে দিল। বিশ শতক, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য, আধুনিকতার পথে ধীরে ধীরে বাঙালির পা বাড়ানো, ঘরের আগল ভেঙে মেয়েদের শিক্ষা ও সংস্কৃতির জগতে প্রবেশের সেই উষালগ্নের শেষ প্রতিনিধির চিরপ্রস্থান, বাঙালির ঐতিহ্যের মূল থেকে শতফুল ফোটানোর প্রয়াসের আন্তর্জাতিক মাত্রাটিকে যেন এক শ্রাবণের পবনে আকুল বিষণ্ন সন্ধ্যায় ঢেকে দিল।

অমলার বাবা অক্ষয় নন্দী ছিলেন একজন সফল গয়না ব্যবসায়ী। তাঁর কারবার ছিল কলকাতায়। পরিবার থাকতেন বাটাজোরে। গ্রামের শান্ত পরিবেশ শিশু অমলার শিল্পী মনের বিকাশে খুব জরুরি ভূমিকা পালন করেছিল। তিনের দশকের একদম গোড়ার কথা। ১৯৩০-৩১ সাল হবে। প্যারিসে অনুষ্ঠিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক কলোনিয়াল এক্সপোজিশান। অমলার বাবা অক্ষয় নন্দী অংশ নিয়েছেন সেই প্রদর্শনীতে। আন্তর্জাতিক দুনিয়ার কাছে বাংলার মেয়েদের হাতের কাজ কে তুলে ধরার ক্ষেত্রে অমলার বাবার বিশেষ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। বাবার সঙ্গে ১১ বছরের অমলাও গেলেন ইউরোপ, বিশেষ করে প্যারি শহর দেখার নেশায়।

প্রচণ্ড ভিড় হচ্ছে হচ্ছে প্রদর্শনীতে। একদিন তিন–চারজন ভারতীয় যুবক প্রদর্শনীতে অক্ষয়বাবুর স্টল দেখতে এলেন। তাঁদের ভেতরে ছিলেন উদয়শঙ্কর, তিমিরবরণ আর বিষ্ণুদাস শিরালি। মাত্র ১১ বছরের মেয়ে তখন অমলা। তাঁর ধারণা ছিল, উদয়শঙ্কর বুঝি আশি-পঁচাশি বছরের কোনো বৃদ্ধ হবেন।

অমলার এই ধারণা থেকে এটা খুব পরিষ্কার হয়ে যায় যে গত শতকের তিনের দশকে, সেদিনের পূর্ববঙ্গ, আজকের বাংলাদেশে, একটি জেলার প্রত্যন্ত একটি গ্রামেও সাংস্কৃতিক ধারার হালহকিকত ঘিরে কতখানি চর্চা ছিল। অবিভক্ত বাংলার সাংস্কৃতিক জনজোয়ারে বাংলাদেশের মেয়েরা কতখানি অগ্রবর্তী ছিলেন, প্রায় বালিকা অমলাশঙ্করের প্রথম উদয়শঙ্করকে দেখার অনুভূতির ভেতর দিয়ে তা বোঝা যায়।

প্যারিসের ‘রুঁ দ্যাঁ পারি’তে উদয়শঙ্করের বাড়ি সাদা খদ্দরের পাজামা-পাঞ্জাবি পরা কয়েকজন কিশোরের ভলিবল খেলা, আর তাঁদের ভেতরেই তাঁর আদরের ‘রবু’, বাঙালির অহঙ্কার পণ্ডিত রবিশঙ্করকে দেখার স্মৃতি অমলা কোনো দিন ভুলতে পারেননি। সেখানেই অমলা প্রথম দেখেন হেমাঙ্গিনী দেবীকে, উদয়-রবির মা। অমলা বলতেন, হেমাঙ্গিনী আর শ্যামশঙ্কর (উদয়শঙ্করের বাবা) সম্পর্কে না জানলে শঙ্কর পরিবারকেই জানা হয় না। অমলা ছিলেন একজন অকপট সত্য কথা বলা মানুষ। নিজের জীবনের কান্না–হাসির মতোই হেমাঙ্গিনী-শ্যামশঙ্করের জীবনের জটিলতাকেও তিনি কখনো গোপন করেননি। শ্যামশঙ্করের বিদেশিনী স্ত্রীকে কীভাবে দেখেছিলেন হেমাঙ্গিনী, সেই বিদেশিনীর মৃত্যুর পর ও স্বামীর প্রতি কর্তব্যপরায়ণতায় পরম নিষ্ঠাবতী হেমাঙ্গিনী—এসব কথার অকপট স্বীকারোক্তির ভেতর দিয়ে কিন্তু অমলাশঙ্কর তাঁর শিল্পীসত্তার সম্যক ঔদার্য, যার দায়েই হয়তো তাঁর নিজের ব্যক্তিজীবন অনেকখানি ঝড়ঝাপটার ভেতরে পড়তে হয়েছিল। অথচ এসব সত্ত্বেও সন্তানের যত্ন থেকে, শিল্পচর্চা—প্রতিটি প্রশ্নে অমলার অচঞ্চল, স্থির, প্রাজ্ঞ, ধীশক্তিসম্পন্ন পদচারণের অভিব্যক্তিগুলো সহজেই বুঝতে পারা যায়। শৈল্পিক বিকাশে অমলার ওপর উদয়শঙ্করের অনবদ্য প্রভাব সত্ত্বেও, যাপনচিত্রে উদয়ের কাছ থেকে পাওয়া যন্ত্রণাকে অমলা হয়তো জয় করতে পেরেছিলেন শশ্রুমাতা হেমাঙ্গিনীর অসামান্য জীবনকে আত্মস্থ করার ভেতর দিয়ে।

কলকাতার বুকে ভদ্রঘরের মেয়েদের তখন প্রকাশ্য মঞ্চে একক নৃত্যের চল ছিলই না। রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে নৃত্যনাট্যে মেয়েদের উপযুক্ত মর্যাদা দিতে শুরু করেছেন। কলকাতায় সমবেত নৃত্যে, বিশেষ করে নৃত্যনাট্যে মেয়েদের তিনি প্রতিষ্ঠা দিচ্ছেন। মেয়েদের নিয়ে নৃত্যনাট্য দলসহ তিনি গোটা দেশে ধীরে ধীরে শান্তিনিকেতনের জন্য অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশে অনুষ্ঠান করছেন। প্রশংসা ও সমালোচনা—দুই–ই জুটছে কবির।

এ রকম একটি সামাজিক পরিবেশে ’৩২ সালের অক্টোবর মাসের বেশ কিছু আগে, কলকাতায় একক নৃত্যের আয়োজন করলেন সাধনা বসু। বাংলার সাংস্কৃতিক বিপ্লবে তিনি নিজেই ছিলেন এক কালজয়ী অধ্যায়। এর আগে প্রকাশ্যে বাঙালি সমাজের ভদ্র ঘরের মেয়েরা স্টেজ পারফরম্যান্সের কথা ভাবতেই পারতেন না। মেয়েদের প্রকাশ্য নৃত্যের বিষয়টি ছিল প্রধানত বারবণিতা, বাঈজি জগতের এখতিয়ারে।

এ অবস্থায় প্রকাশ্য মঞ্চে সাধনা বসুর নৃত্য পরিবেশনা। সেটি দেখতে গেলেন অমলা। তাঁর পরিবারের আধুনিক মানসিকতার বিশেষ পরিচয় পাওয়া যায় এ ঘটনাটির ভেতর দিয়ে। সাধনা বসু একদিকে অমলাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করলেন, অন্যদিকে নাচ ঘিরে রক্ষণশীল বাঙালি পরিবারগুলোর মতো ট্যাবুর সঙ্গে পারিবারিকভাবে তাঁকে যুদ্ধ করতে না হওয়া, এটি সামগ্রিকভাবে বাটাজোরের ছোট্ট অমলাকে, কিংবদন্তি অমলাশঙ্কর হতে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিল।

শতায়ু অমলাশঙ্করকে আমরা খুব একটা শিল্পের পরিমণ্ডলের বাইরে সমাজমনস্কতার জগতে দেখতে পাই না। তাঁর সমসাময়িক নৃত্যশিল্পীদের ভেতর রূপকিনী দেবী, কমলা দেবী চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ ছিলেন অসম্ভব সমাজসচেতন শিল্পী। শৈল্পিক নিষ্ঠাকে সামাজিক প্রগতির একটা মাধ্যম হিসেবে তাঁরা ব্যবহার করেছিলেন। অমলাশঙ্কর নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন কেবল নৃত্যচর্চার পরিমণ্ডলেই। উদয়শঙ্করকে ঘিরে যে ধরনের ব্যক্তিজীবনের সমস্যার ভেতরে অমলাকে পড়তে হয়েছিল, প্রায় তেমন সমস্যাই কমলা দেবী চট্টোপাধ্যায়কেও পড়তে হয়েছিল তাঁর স্বামী হারীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়কে ঘিরে। তবে ব্যক্তিজীবনের সেই সমস্যার দরুণ নিজের শিল্পচর্চা ও সমাজমনস্কতা—কোনোটা থেকেই কমলা সরেননি।

অমলাশঙ্কর সেই অর্থে তাঁর দাম্পত্য জীবনের স্বর্ণযুগে ও কখনো সামাজিক কোনো বিষয় ঘিরে উৎসাহ দেখাননি, কেবল নৃত্যচর্চাতেই নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। উদয়শঙ্করের সঙ্গে ইন্ডিয়া কালচার সেন্টার ঘিরে মানসিক ও সামাজিক দূরত্ব তৈরি হওয়ার পর ও সমাজমনস্ক পরিমণ্ডলের সঙ্গে নিজের কোনো নৈকট্য তৈরি করেননি। নৃত্যচর্চা, পারিবারিক জীবন, বিশেষ করে সন্তান পালনেই নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন।

উদয়শঙ্করকে তাঁর শেষজীবনে হয় রাস্তায় ভিক্ষা করতে হতো, যদি না তাঁর বন্ধু, তথা বিশিষ্ট শিক্ষাব্রতী সতীকান্ত গুহ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন। ’৭৫–এর ১১ মার্চ সতীকান্তকে উদয়শঙ্কর লেখেন, ‘আমি আমার পরিবারের সঙ্গে থাকতে ফিরে যাব না। দয়া করে আমাকে উপার্জন এবং থাকার অন্য ব্যবস্থা করার জন্যে আরেকটু সময় দিন।’

এই পর্যায়ক্রম ঘিরে অমলাশঙ্কর প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে দিন কাটিয়েছিলেন। অমলার এই সময়ের যন্ত্রণাবিদ্ধ দিনগুলোর সঙ্গে বুঝি একমাত্র তুলনা চলে বাবা আলাউদ্দিনের কন্যা অন্নপূর্ণা দেবীর রবিশঙ্করকে ঘিরে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ার সময়কালের সঙ্গে। অমলা ও অন্নপূর্ণা—একজন যশোরের অন্যজন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার। বাংলাদেশের দুই কন্যা। নৃত্য ও সেতারে বাঙালির কৃতিত্বকে যাঁরা আন্তর্জাতিক মর্যাদা এনে দিয়েছিলেন, দুই আত্মীয়া, দুজনেরই ব্যক্তিজীবনের যন্ত্রণা যেন তাঁর শৈল্পিক প্রস্ফুটনের সার্বিক পরিব্যাপ্তির ক্ষেত্রে একটা রক্তগোলাপের কাঁটার মতো ক্ষতের সৃষ্টির করেছিল। চিরজীবনই সেই ক্ষত থেকে রক্ত চুইয়ে চুইয়ে পড়েছে। এতটুকু ক্ষরণ না দেখতে দিয়েছিলেন অন্নপূর্ণা। না দিয়েছিলেন অমলা। সেই ক্ষরণকে কণ্ঠে ধারণ করে নীলকণ্ঠ হয়ে বহুদিন আগেই স্তব্ধ হয়ে গেছেন অন্নপূর্ণা। আজ স্তব্ধ হলেন অমলা। বাঙালির দেউলি অমলার নূপুরের করুণ বেহাগের বোল কোনো দিন হারাবে না।