উন্নয়ন ডেস্ক –
মঙ্গলবার সমকালের শীর্ষ প্রতিবেদনে কক্সবাজারের বাঁকখালী নদী ও তার পার্শ্ববর্তী প্যারাবন দখলের যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে; তা যথেষ্ট উদ্বেগজনক। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাঁকখালী নদীর তীরে এক দশক আগে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে উপকূলকে বাঁচাতে গড়ে তোলা হয় প্যারাবন। কিন্তু গত কয়েক বছরে বনের একটা বড় অংশ তো বটেই; নদীরও অনেকাংশ চলে গেছে ভূমিখেকোদের দখলে। বনের ভেতরে নদীর শুকিয়ে যাওয়া সাত কিলোমিটারজুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে পোলট্রি খামার, দোকানপাট, চাল-ময়দার মিল আর ঘরবাড়ি। এমনকি নদী ও বনের জমি প্লট বানিয়ে প্রতি প্লট ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকায় কেনাবেচাও চলছে। দুঃখজনক বিষয় হলো, এসবকিছু চলছে স্থানীয় প্রশাসনের একেবারে নাকের ডগায়। কিন্তু তাদের পক্ষ থেকে এর বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। এমনকি উচ্চ আদালতের নির্দেশের পরও তাদের এ উদাসীনতার অবসান ঘটছে না। জানা গেছে, ২০১৪ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) ওই নদী ও বন রক্ষায় প্রশাসনের কার্যকর পদক্ষেপ চেয়ে হাইকোর্টে একটা রিট করেছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট কক্সবাজার জেলা প্রশাসনকে দখলদারদের তালিকা প্রকাশের পাশাপাশি জরিপ করে দখল হওয়া জমি পুনরুদ্ধারের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সেই নির্দেশ শেষ পর্যন্ত এক ধরনের অরণ্যে রোদনে পর্যবসিত হয়েছে।
প্রতিবেদনে স্পষ্ট করে বলা আছে, কক্সবাজারের পৌর মেয়রসহ ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাদের অনেকে এ দখলবাজির সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু জেলা প্রশাসন ওই নদী ও বন দখলকারীদের যে তালিকা করেছে, সেখানে মেয়রসহ অনেক প্রভাবশালীর নাম নেই। এতে বোঝা যায়, জেলা প্রশাসন হয় ওই সরকারদলীয় নেতাদের দ্বারা সংঘটিত অপরাধের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ভয় পায় অথবা ওই প্রভাবশালীদের সঙ্গে কোনো অশুভ আঁতাতে আবদ্ধ। এদিকে যে বন বিভাগের ওপর ওই প্যারাবন রক্ষণাবেক্ষণ করার দায়িত্ব; তারাও দখলদারদের বিরুদ্ধে একটা মামলা করেই হাত গুটিয়ে বসে আছে বলে জানা যায়। এ অবস্থায় সরকারের উচ্চ মহল থেকে দৃঢ় কোনো পদক্ষেপ ছাড়া বাঁকখালী নদী ও তীরবর্তী বন রক্ষা করা যাবে না। মনে রাখতে হবে, সরকারের নির্লিপ্ততা শুধু ওই নদী ও প্যারাবনকেই উধাও করে দেবে না; অন্যত্রও দখলদাররা একই অপরাধে লিপ্ত হতে আশকারা পাবে। আর তা সাগর-পাহাড় সমন্বিত অনন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত একটা জেলাকে এমনকি মানুষের বসবাসের অনুপযোগীও করে তুলতে পারে।
বন, নদী কিংবা জলাশয় দখল শুধু কক্সবাজারে নয়; সারাদেশেই চলছে। প্রায় সর্বক্ষেত্রে দেখা গেছে, দখলদাররা হয় সরাসরি ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত, না হয় ক্ষমতাসীন দলের আশীর্বাদধন্য। বলা বাহুল্য, এ চিত্রটি শুধু যে বর্তমান সরকারের আমলে দেখা যাচ্ছে, তা নয়; অতীতের প্রায় সব সরকারের আমলেই তা দেখা গেছে। ফলে এ অবস্থার অবসান ঘটাতে হলে পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষার বিষয়ে ক্ষমতাসীন দলের দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার থাকতে হবে। আশার কথা, বর্তমান সরকার তার নির্বাচনী ইশতেহারে এ বিষয়ে স্পষ্ট প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সম্ভবত সেই প্রতিশ্রুতি থেকেই ঢাকা শহরের চারপাশের নদীগুলোকে দূষণ ও দখলমুক্ত করার লক্ষ্যে আমরা গত কয়েক মাস ধরে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও অন্যান্য সংস্থার পক্ষ থেকে বেশ জোরালো অভিযান লক্ষ্য করছি। ঢাকা শহরের ভেতরের খালগুলো দখলমুক্ত করার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে বেশ কিছু অভিযান পরিচালিত হতে দেখা গেছে।
আমরা চাই, বন-নদী-জলাশয়খেকোদের বিরুদ্ধে অভিযান রাজধানীতে সীমাবদ্ধ না রেখে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ুক। দখলদাররা যাতে ক্ষমতাসীন দলের কোনো পর্যায় থেকে কোনো প্রকার আশ্রয়-প্রশ্রয় না পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। কক্সবাজারের ঘটনায় হাইকোর্টের নির্দেশ পালনে স্থানীয় প্রশাসন কোন দুঃসাহসে উদাসীনতা দেখাচ্ছে, তাও খতিয়ে দেখা জরুরি। যদি জবাবদিহি নিশ্চিত করা হতো, তাহলে ওই দখলদাররা অব্যাহতভাবে বাঁকখালী নদী ও বন দখল করার সাহস পেত না। আমরা সচেতন নাগরিকদেরও এ বিষয়ে সোচ্চার থাকার আহ্বান জানাই।