কিশোর গ্যাং: সমাজের ক্ষত বিস্তৃত হচ্ছে

উন্নয়ন ডেস্ক –

দেশের বিভিন্ন এলাকায় কিশোর গ্যাং অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। তারা কতটা দুর্দমনীয় হয়ে পড়েছে; মঙ্গলবার মিডিয়ায় প্রকাশিত সচিত্র প্রতিবেদনটি তারই দৃষ্টান্ত। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নারায়ণগঞ্জের পাড়া-মহল্লায় বেপরোয়া কিশোর গ্যাংয়ের সন্ত্রাসীদের ভয়ে সাধারণ মানুষ তটস্থ। কিশোর সন্ত্রাসীরা ধারালো অস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্যে দাপিয়ে বেড়ায়। বিস্ময়কর হলো, একের পর এক তাদের দ্বারা সংঘটিত ঘটনার পরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় সক্রিয় নয়। এ সপ্তাহের গোড়ায় কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় ওই এলাকায় আহত হয়েছেন পাঁচজন। নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার ঘটনাগুলোর সঙ্গে কিশোর গ্যাংয়ের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করলেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশের ভূমিকার ব্যাপারে তার বক্তব্য অনেকটাই যেন দায়সারা।

নারায়ণগঞ্জের ঘটনাটি খণ্ডিত দৃষ্টান্ত বটে, তবে এ ব্যাপারে অখণ্ড চিত্র পর্যালোচনা করলে উদ্বিগ্ন না হয়ে উপায় থাকে না। সমকালে ১১ মে গলাচিপার বোয়ালিয়া খাল এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের সন্ত্রাসীদের ধারালো অস্ত্র নিয়ে মহড়ার যে ছবি ছাপা হয়েছে, তা দেখে শান্তিপ্রিয় যে কারও মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে- এই অপশক্তির শক্তির উৎস কোথায়! আমরা জানি, বখাটেদের এই ঔদ্ধত্যের পেছনে অনেক ক্ষেত্রেই সবচেয়ে প্রভাবশালী কারণটি হলো রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি। আমরা সংবাদমাধ্যমেই দেখেছি, প্রধানত স্থানীয় ক্ষমতাবানদের রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় কিশোর গ্যাংগুলো পরিচালিত হয়।

সংবাদমাধ্যমে এও দেখা গিয়েছিল, বিভিন্ন এলাকায় পুলিশের তালিকায় কিশোর গ্যাংয়ের রাজনৈতিক আশ্রয়দাতা বা পৃষ্ঠপোষক হিসেবে এমন অনেকের নামই উঠে এসেছিল, যারা রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। আমরা দেখছি, বিগত কয়েক বছর ধরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় কিশোর গ্যাং অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। কিশোরদের বয়স বিবেচনায় আইনের সীমাবদ্ধতা এ ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, কিশোর অপরাধীদের পুলিশ গ্রেপ্তার করলেও তাদের সংশোধনাগারে পাঠানো ছাড়া জোরালো আইনি কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যাচ্ছে না। উদ্বেগের কারণ হলো- সংশোধনাগারে পাঠানো হলে সেখান থেকে নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে তারা ফিরে এসে ফের জড়িয়ে পড়ছে এই গ্যাংয়ের সঙ্গেই। তা ছাড়া সংশোধনাগারগুলোর ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি ও সংশোধন প্রক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন আছে বিস্তর।

কিশোর গ্যাংয়ের বেপরোয়া আচরণ এক সময় নগর বা মহানগরকেন্দ্রিক হলেও এখন সারাদেশেই কমবেশি দৃশ্যমান। উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে সমাজের ক্ষতস্থান দেশব্যাপী বিস্তৃত হচ্ছে। তারা মাদকের নেশায় ছিনতাই, চুরি, ইভটিজিংসহ জড়িয়ে পড়ছে মাদকের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বাহক হিসেবেও। এও দেখা গেছে, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব কিংবা অন্য গ্যাংয়ের সঙ্গে বিরোধকে কেন্দ্র করে খুন-খারাবি করছে। অভিযোগ আছে, তাদের অনেকেই ভাড়াটে হিসেবে হত্যাকাণ্ডে যুক্ত হচ্ছে। আমাদের মনে আছে, এ বছরের জানুয়ারি মাসে রাজধানীর মিরপুরে পোশাক কারখানার এক কর্মীকে হত্যা করতে মোটা অঙ্কের টাকার চুক্তিতে কিশোর গ্যাংয়ের ক’জনকে ভাড়া করেছিল প্রতিপক্ষ। দেখা গেছে, গ্যাং সদস্য অনেকেই স্কুল থেকে ঝরে পড়া ও সমাজের অবহেলিত শ্রেণির পরিবার-বিচ্ছিন্ন সদস্য। আমরা মনে করি, কার্যকারণ যা-ই হোক পরিবার ও সমাজের ইতিবাচক পদক্ষেপ ও প্রশাসনের কঠোর অবস্থান ছাড়া এই বিপথগামীদের পথে ফেরানো দুরূহ।

আমরা এও মনে করি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের স্তরে স্তরে দুর্নীতি, অপরাধ ও অপরাধের যে নানা উপাদান রয়েছে; কিশোররা এর বাইরে নয়। পারিবারিক বন্ধন অনেক ক্ষেত্রেই ঢিলে হয়ে পড়েছে। এর পাশাপাশি সুস্থ বিনোদন ও সংস্কৃতিচর্চার অভাব, বয়সের অপরিপকস্ফতা, অর্থলোভ, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, হিরোইজম কিশোর অপরাধ বৃদ্ধির কারণ। কিশোরদের রাজনৈতিকভাবে অপব্যবহারেরও ভয়াবহ কুফল এই চিত্র। সমাজে বিদ্যমান নানা অসংগতি, বৈষম্য, দারিদ্র্য, হতাশার পাশাপাশি যারা পর্দার আড়ালে থেকে কিশোরদের বিপথগামী হওয়ার পথ তৈরি করে দেয় নিজেদের হীনস্বার্থে; এর সবকিছুর নিরসন ঘটাতেই হবে। কিশোরদের মানসিক বিকাশ ও সুষ্ঠু সামাজিকীকরণের জন্য সৃষ্টি করতে হবে গঠনমূলক পরিবেশ এবং যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নতুন করে ভাবতে হবে আইনি প্রক্রিয়া নিয়েও। অপরাধপ্রবণরা শুধু ব্যক্তিবিশেষেরই ক্ষতি করে না, গোটা সমাজেরও ক্ষতি করে। জনপ্রতিনিধি, সমাজের প্রতিনিধিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের এ ব্যাপারে যূথবদ্ধ প্রয়াসের বিকল্প নেই।