উন্নয়ন ডেস্ক –
কল্পনাকে তুলির আঁচড় দিয়ে সার্থক রূপায়ণ করতে সক্ষম হয়েছেন জয়নুল আবেদিন (২৯ ডিসেম্বর, ১৯১৪-২৮ মে, ১৯৭৬)। তিনি গণমানুষের চিত্রশিল্পী। ১৯৪৩ সালে জয়নুল আবেদিনের বয়স ছিল ঊনত্রিশ বছর। ইতোমধ্যে তার কাজের খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষ ও প্রকৃতিকে পর্যবেক্ষণ করে জয়নুল খুঁজে নিচ্ছিলেন নিজস্ব আঙ্গিক। জয়নুল ১৯৪৩ সালে ব্রিটিশ সরকার সৃষ্ট দুর্ভিক্ষের ছবি আঁকলেন। হৃদয়বিদারক সে ছবি! তিনি বললেন, ‘মানুষ আর কুকুর একলগে যখন ডাস্টবিনের খাওন লইয়া কাড়াকাড়ি কইরা খায় তখন বুকটা ফাইটা যায়। এই কথা দুনিয়ার মাইনষেরে আমি কইছি ছবিতে ধইরা দেহাইছি, মানুষ কত নিষ্ঠুর অইতে পারে। মানুষ তার ভাইয়েরে কেমনে কুত্তার পাশে নামাইতে পারে।’ সে সময় তার নির্বাচিত বারোটি স্কেচ নিয়ে একটি অ্যালবাম বের হয়, যার নাম ছিল ‘ডার্কেনিং ডেজ অফ বেঙ্গল’। ১৯৩৮ সালের দিকে স্পেনে গৃহযুদ্ধ চলছিল। এ সুযোগে স্পেনের গের্নিকায় (শহর) বোমাবর্ষণ করে জার্মান আর ইতালির সম্মিলিত যুদ্ধবিমানের মাধ্যমে। অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয় এতে। পিকাসো আঁকলেন। চিত্রকর্মের মাধ্যমে প্রতিবাদ করলেন। গের্নিকা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে একটি বিবৃতিস্বরূপ, যুদ্ধ বিয়োগান্তক এবং বিশেষ করে নিরপরাধ বেসামরিক জনগণের ওপর বর্বরতা যন্ত্রণা প্রকাশ করে। চিত্র যে কথা বলে আমরা পাবলো পিকাসোর কিছু ছবি দেখলেই বুঝতে পারব। তুলির মাধ্যমে এক ছবিই অনেক ইঙ্গিত দেয়, প্রতিবাদ করে অন্যায়ের। আবার প্রেমের অনুপম নিদর্শন তুলে ধরেছেন। হতাশার চিত্রও পাই তার অনেক ছবিতে। আমরা জানি জয়নুল আবেদিন বাংলার দুর্ভিক্ষের স্কেচের জন্য পরিচিত। তিনি আঁকেন মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষের স্কেচের সিরিজ যা ছড়িয়ে পড়েছিল সারা বাংলায় লক্ষাধিক মানুষ মরার খবর। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময় অনেক মানুষের মৃতু্যর কারণ বলে জানা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান বার্মাসহ বেশিরভাগ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো দখল করেছিল; অনুমান করা হয়েছিল যে বাংলার পতন হবে। সম্ভাব্য শত্রম্নর দখলের প্রস্তুতির জন্য, সরকার বাঙালি ধানের মজুদ অপসারণ করে, দেশের নৌযান ধ্বংস করে, নদী-যোগাযোগ পথকে অচল করে দেয়। এসব পদক্ষেপগুলো খাদ্য সরবরাহকে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করেছিল। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতি, ক্রমবর্ধমান মূল্য এবং প্রয়োজনীয় পণ্যের মজুদ দুর্ভিক্ষ সৃষ্টিতে অনুঘটকের কাজ করে। আধুনিক শিল্পের প্রবর্তক জয়নুল আবেদিন তার বাংলার ‘দুর্ভিক্ষের স্কেচ’-এর জন্য ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হন। কালি এবং প্রয়োজনে বুরুশ ব্যবহার করে তিনি স্কেচ তৈরি করেছিলেন; যা পরে মানুষের দুঃখ-কষ্টের আইকনিক চিত্র হয়ে ওঠে। কাগজ বা কার্ডবোর্ডে ব্রাশ দিয়ে, কালো কালি দিয়ে তৈরি তথ্যচিত্র বস্তুনিষ্ঠতা এবং একটি শৈল্পিক শক্তি রয়েছে; যেটিতে স্বতঃস্ফূর্ততা, আন্তরিকতা এবং বাস্তবতা রয়েছে। দীর্ঘকাল অতিবাহিত একটি অভিজ্ঞতার সচিত্র উপস্থাপনা জয়নুলে তুলিতে ধরা দিয়েছে। তার চিত্রের মূলশক্তি বা চালিকাশক্তি হচ্ছে আবেগ; আবেগ ঢেলে দেওয়া। দুর্ভিক্ষের স্কেচগুলি ছিল নিষ্ঠুরতা এবং দুর্ভিক্ষের চিত্র মৃতু্যর বণিক, এবং শিকারের সম্পূর্ণ অসহায়ত্ব ইত্যাদির চিত্র। দুর্ভিক্ষের অশুভ চেহারাও দেখিয়েছে; মানুষের কঙ্কালের পরিসংখ্যান মানবসৃষ্ট অনাহারে মারা যাওয়ার ভাগ্য, দুর্দশা ইত্যাদির মতো মর্মান্তিক ছবিগুলো মানব মমতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। স্কেচগুলো প্রথম প্রকাশিত হয় কলকাতার দৈনিক ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকায়। তার পরই জয়নুল আবেদিন সারা ভারতে পরিচিতি লাভ করেন। দুর্ভিক্ষের স্কেচ কঙ্কালের পরিসংখ্যানের মাধ্যমে অশুভ মুখ দেখিয়ে মানবসৃষ্ট সমস্যাটির জন্য অনাহারে মারা যাওয়ার দৃশ্য তুলে আনতে সক্ষম হয়েছেন। ১৯৪৪ সালে এগুলো প্রদর্শিত হলে তিনি ভারতবর্ষ পেরিয়ে বিশ্বদরবারে অধিক প্রশংসিত হন। ক্ষোভ থেকেই দুর্ভিক্ষের ছবিগুলো এঁকেছেন তিনি। তখনকার মনুষ্যসৃষ্টি সে সময়ের দুর্ভিক্ষের অবস্থার প্রতিবাদ হিসেবে তার মতামত উঠে এসেছে বলে তিনি মনে করেন। মানুষের যন্ত্রণা, ক্ষুধার জ্বালার উপলব্ধি ইত্যাদি জয়নুলের হৃদয়কে স্পর্শ ও নাড়া দিয়েছিল। সে সময়ে কলকাতায় গিয়েছিলেন বাস্তব অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে। তিনি আরও দেশে ভ্রমণ করেছিলেন। ফিলিস্তিন ও জর্ডানের ফিলিস্তিনি মানুষের দুঃখ-দুর্দশা নিজ চোখে দেখেছেন। পরবর্তী সময়ে ক্ষোভ ও প্রতিবাদ উগড়ে দিয়েছেন তুলির মাধ্যমে। তেতালিস্নশের মন্বন্তর পর্বে একগুচ্ছ মর্মস্পর্শী ছবির মধ্যে দিয়ে তার খ্যাতি বিশ্বে দরবারে পৌঁছে যায়। বাঙালির হৃদয়ে গ্রোথিত হয় প্রবলভাবে। ‘ডার্কেনিং ডেজ অফ বেঙ্গল’ অ্যালবামটির জনপ্রিয়তায় আতঙ্কিত হয় ব্রিটিশ সরকার এবং বাজেয়াপ্ত করে। এই অ্যালবামটি গ্রন্থনা করেছিলেন ইলা সেন। সংকলনটিকে দর্শকের সামনে থেকে সরিয়ে নিতে বাধ্য হন শিল্পী ও প্রকাশক। কিন্তু ছবিগুলো বিশ্বসম্প্রদায় ও বাঙালির হৃদয়ে স্থায়ী ছাপ রেখে দেয়। চিত্রমালার রেখাগুলো সজারুর কাঁটার মতো তীক্ষ্ন হয়ে আমাদের বিদ্ধ করে। বিখ্যাত একটি চিত্রকর্ম হচ্ছে গের্নিকা (স্পেনীয় শব্দ এঁবৎহরপধ থেকে)। এটির স্রষ্টা বিশ্ববিখ্যাত চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসো। এটি স্পেনীয় গৃহযুদ্ধের সময়কে নিয়ে আঁকা ছবি। ১৯৩৮ সালের ২৬ এপ্রিল জার্মান এবং ইতালীয় যুদ্ধ বিমান কর্তৃক উত্তর স্পেনের একটি গ্রামে (গের্নিকা) বোমাবর্ষণ করা হয়েছিল। অমানবিক এ কর্মকান্ডের প্রতিক্রিয়া হিসেবে এটি আঁকেন পিকাসো। ‘গোয়ের্নিকা’-র কয়েক বছর পরে কলকাতার রাস্তার মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ও চরম অমানবিকতার চিত্র তুলে ধরেন বাংলাদেশের তখনকার তরুণ চিত্রশিলী জয়নুল আবেদিন। জয়নুলের করুণ দুর্ভিক্ষের চিত্রমালা কেবল অস্থিসার মানুষের কঙ্কালের ছবি নয়, মানবতার শত্রম্ন ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাস্ত্র। পিকাসোর ‘গোয়ের্নিকা’ এবং জয়নুলের ‘দুর্ভিক্ষের চিত্রমালা’-র বার্তা কিন্তু একই। মানবতার পক্ষে, অত্যাচারীর বিপক্ষে যুদ্ধাস্ত্র। বুভুক্ষু মানুষের সীমাহীন যন্ত্রণার হৃদয়বিদারক দৃশ্য জয়নুলের এই চিত্রমালায় উঠে আসে। অত্যাচারী-সরকারের ভিত কাঁপিয়েছিল এ অ্যালবামটি। তখনকার দুর্ভিক্ষের জীবন্ত এক দলিল এটি। হয়ে ওঠে গণমানুষের বিদ্রোহী কণ্ঠস্বর।