ধর্মচর্চা সংস্কৃতির অপরিহার্য অংশ

উন্নয়ন ডেস্ক –

‘সংস্কৃতি’ শব্দটি দিন দিন ব্যাপকতা হারাচ্ছে। ব্যাপক অর্থবহ এই শব্দটির মধ্যে অন্য উপাদানের সঙ্গে ধর্মবিশ্বাসও যে অন্তর্ভুক্ত, তা বলাই বাহুল্য। ধর্ম ও সংস্কৃতি বিপরীত অর্থবোধক দুই মেরুর দুটি শব্দ নয়। ধর্মীয় বিশ্বাস সংস্কৃতির অঙ্গনে একটি জীবন্ত শক্তি। সংস্কৃতির সংজ্ঞা ও বিশ্লেষণ নিয়ে নানা মতপার্থক্য থকলেও ধর্মীয় বিশ্বাস যে সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ, তা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সাংস্কৃতিক নীতিমালা চিহ্নিত করতে গিয়ে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ইউনেসকো অনেকগুলো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৯৮২ সালে মেক্সিকো শহরে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনের সিদ্ধান্তগুলো বাংলাদেশ কর্তৃক অনুস্বাক্ষরিত হয়।

সংস্কৃতির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সম্মেলন ঘোষণা করে : ‘ব্যাপক অর্থে সংস্কৃতি হচ্ছে একটি জাতির অথবা একটি সামাজিক গোত্রের আত্মিক, বস্তুগত, বুদ্ধিগত, আবেগগত এবং চিন্তা ও কর্মধারার প্রকাশ। শিল্প ও সাহিত্যই কেবল সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত নয়, মানুষের জীবনধারাও সংস্কৃতির অঙ্গ। মানুষের অধিকার, মূল্যবোধ ঐতিহ্য এবং ধর্ম ও বিশ্বাসও সংস্কৃতির অঙ্গ।’

এই সম্মেলনে সাংস্কৃতিক নিদর্শন সম্পর্কে যেসব সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, তার একটিতে বলা হয়, ‘একটি জাতির সংস্কৃতির ঐতিহ্য হিসেবে যেসব বিষয় গণ্য হবে তা হচ্ছে—শিল্প, সাহিত্য, স্থপতিদের নির্মাণকর্ম, বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার, মানুষের ধর্মবোধ এবং সেসব মূল্যবোধ যা জীবনকে অর্থবহ করে তোলে। মানুষের ভাব প্রকাশের ভাষা, সামাজিক রীতি-নীতি, বিশ্বাস, ঐতিহাসিক নিদর্শন, নৃতত্ত্ব, গ্রন্থাগার সব কিছুই সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত।’

সম্মেলনে আনীত প্রস্তাবে আরো বলা হয়, যুবকদের চরিত্র ও মানসিকতা গঠনের জন্য ধর্ম এবং আত্মিক আদর্শ সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পৃথিবীর সব দেশেই এই গুরুত্ব অল্প-বিস্তর তারতম্যসহ বিদ্যমান। সেই কারণে ইউনেসকো মনে করে, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক চৈতন্যের মূলে ধর্মের প্রভাব রয়েছে। সুতরাং পৃথিবীর সব দেশের কর্তব্য হচ্ছে, ধর্ম ও আত্মিক চৈতন্যকে যথার্থ গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা এবং শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক নীতিমালা নির্ধারণের সময় ধর্মের স্থান সম্পর্কে সচেতনভাবে চিন্তা করা। সুতরাং এ ক্ষেত্রে ইউনেসকোর প্রস্তাবনা হচ্ছে—১. একটি দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনাকে সে দেশের ঐতিহাসিক, ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক পরিপেক্ষিতে বিবেচনা করা। ২. সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় ধর্মীয় বিশ্বাস এবং আত্মিক চৈতন্যকে পূর্ণ মর্যাদা প্রদান। ৩. ধর্মের একটি আন্তর্জাতিক সর্বমানববাদী রূপ রয়েছে। সেই রূপকে সংরক্ষণ করা এবং তা সংস্কৃতিকে সমন্বিত করা।’

ইউনেসকোর সিদ্ধান্তের আলোকে আমরা বলতে পারি, আমাদের দেশের জনসাধারণের কাছে ধর্মীয় বিশ্বাস সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ধর্মীয় বিশ্বাসবহির্ভূত সংস্কৃতি আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি নয়; বরং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও তা অসম্পূর্ণ সংস্কৃতি বলে বিবেচিত। বাংলাদেশে ধর্মীয় বিশ্বাস এবং প্রেরণা সংস্কৃতি বিকাশের ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করে আসছে আবহমানকাল থেকেই। এ দেশের বিভিন্ন উৎসবের উৎস অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে সেগুলোর প্রায় সব কটিই ধর্মভিত্তিক। তবে ধর্মভিত্তিক হয়েও সেসব উৎসবের আয়োজনে একটি উদারতা, সহনশীলতা এবং সব শ্রেণির মানুষকে একসঙ্গে গ্রহণ করার প্রবণতা লক্ষ করা যায়।

বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে বিভিন্ন উপকরণের মিশ্রণ ঘটেছে। ধর্মীয় প্রভাব এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রধান ও সংখ্যাগরিষ্ঠদের ধর্ম হিসেবে ইসলামের প্রভাব বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে প্রবল। সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান উপাদান ধর্মবিশ্বাসের কারণে সংস্কৃতিতে বৈচিত্র্য সৃষ্টি হয়। প্রসঙ্গত, ইসলাম ধর্মের মূল হচ্ছে সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাআলার অস্তিত্বে বিশ্বাস। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যায়, ধর্ম এখানে শুধু ধর্মীয় রীতি-নীতি এবং অনুশাসনই নিয়ন্ত্রণ করেনি; বরং মানুষের সামগ্রিক জীবনধারাকেও প্রভাবিত করেছে।

বঙ্গদেশে মুসলিম শাসন ছিল ত্রয়োদশ শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকে ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। তখন থেকেই এ দেশে দেশীয় ভাষার চর্চা হতে থাকে। মধ্যযুগের বাংলা কাব্যের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশের মূলে মুসলমান শাসনকর্তাদের সমর্থন ও সহায়তা ছিল। মুসলমান আমলে ধর্মীয় ভাষা ‘আরবি’ ও দরবারের ভাষা ‘ফারসি’ হওয়া সত্ত্বেও সাহিত্যের ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা চর্চায় মুসলমান রাজন্যবর্গ উৎসাহ প্রদান করেছেন। এই সময়ে বাংলা ভাষার মধ্যে প্রচুর পরিমাণে আরবি, ফারসি ও তুর্কি শব্দ প্রবেশ করে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করে তোলে। সে সময়ে এ দেশে সংস্কৃতির নতুন দ্বার উন্মোচিত হয় এবং ধীরে ধীরে বিকাশ ঘটতে থাকে।

বিকশিত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের মাধ্যমে একটি দেশ ও জাতি তার স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্যবোধকে অক্ষুণ্ন রাখতে পারে। তবে সংস্কৃতির প্রধান কোনো উপাদান বা অনুষঙ্গ বাদ দিয়ে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ কোনোভাবেই সম্ভব নয়। ইতিহাসের আলোকে বর্তমানকে সাজাতে এবং ভবিষ্যেক গড়তে হবে। ধর্ম, ভাষা, লোকাচার—সব কিছুর সমন্বয়ে আমাদের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক পরিচয়টি সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করতে পারলে আমরা একটি সুসংহত ও সমৃদ্ধিশালী জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারব, ইনশাআল্লাহ।