নগদ অর্থ সরবরাহ বৃদ্ধি ও দুই বছর মেয়াদি পুনরুদ্ধার কৌশল জরুরি

উন্নয়ন ডেস্ক –

বিশ্ব জুড়ে করোনা ভাইরাস প্রকোপের মধ্যেও শুধু অর্থবছরের শুরুতে জুলাই মাসে প্রবাসীরা ২৬০ কোটি মার্কিন ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। একক মাস হিসেবে এর আগে কখনো এত পরিমাণ রেমিট্যান্স আসেনি। এর ওপর ভর করেই রিজার্ভ রেকর্ড ৩৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, করোনাকালে অনিশ্চিত ভেবে হয়তো প্রবাসীরা তাদের হাতে থাকা শেষ সম্বলটুকু দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। তাছাড়া প্রতিবছরই ঈদকেন্দ্রিক রেমিট্যান্সে উল্লম্ফন দেখা যায়।

তাদের মতে, এতে আত্মতুষ্টিতে ভোগার সুযোগ নেই। বরং করোনা ও লকডাউনের জের ও মন্দার কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতি সামাল দেওয়াই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। টিকে থাকতে হলে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতেই হবে। সেজন্য দরকার সঠিক কর্মকৌশল। ইতিমধ্যে ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজে ভরসা করে থাকলে অর্থনীতির চাকা ঘুরবে না, এমনটা বলছেন উদ্যোক্তারা। তাদের মতে, ভবিষ্যত তো নয়ই, বরং বর্তমানের চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে টিকে থাকার নীতিই হবে উত্তম পন্থা।

বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ করোনাকালীন পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো সাফল্য দেখছেন না। তাদের মতে, স্বাস্থ্য খাতে যেমন ব্যবস্থাপনার সংকট ছিল, তেমনি অর্থনীতিকে সংকটমুক্ত রাখতেও কার্যকর পদক্ষেপের অভাব রয়েছে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, সরকারের প্রথম করণীয় ছিল করোনা সংক্রমণ রোধ করা। সেক্ষেত্রে আমরা সফল হতে পারিনি। তিনি বলেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো করোনার ভ্যাকসিন। নিজেরা করতে পারলে ভালো। না হলে কোন দেশ থেকে আমদানি করা হবে সেটার ব্যবস্থা করা। এজন্য প্রয়োজনীয় নীতিমালা করা। কারণ এটার ওপরই অর্থনৈতিক উন্নয়নসহ অন্যান্য বিষয় নির্ভর করছে। পাশাপাশি বর্তমান অর্থনৈতিক স্থবির অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য এখন করণীয় হলো, যারা চাকরিচ্যুত বা ব্যবসাচ্যুত হয়েছেন তাদের সহায়তা করা। সরকার এখন পর্যন্ত যেটুকু করেছে তা পর্যাপ্ত নয়। সেটা নিয়েও অনেক কথা রয়েছে।

দীর্ঘ মেয়াদে ছুটি ও লকডাউনের নিষেধাজ্ঞা শিথিলের ফলে সবাই চেষ্টা করছেন ক্ষতি পুষিয়ে নিতে। অনেকেই চেয়ে আছেন নীতি সহায়তার কী পরিবর্তন আসে তার দিকে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঘুরে দাঁড়াতে প্রণোদনার পাশাপাশি প্রয়োজন নীতিসহায়তা। করোনার সময়কালে বিভিন্ন দেশে ব্যবসায়ীদের ঋণ দেওয়ার পাশাপাশি রাষ্ট্র তাদের ঋণের জামানত দিচ্ছে, যার কারণে খুব সহজেই তারা ঘুরে দাঁড়ানোর মতো ঋণ বা অর্থায়ন গ্রহণ করতে পারছেন।

ইতিমধ্যে বিভিন্ন চেম্বার ও ব্যবসায়ীদের জোটের পক্ষ থেকে ব্যাংকের বাইরেও নানা সুযোগ দাবি করা হয়েছে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের গ্যাস-বিদ্যুতের বিল পরিশোধে বর্ধিত সময় প্রদান, লাইসেন্স নবায়ন ফি ও ভাড়া মওকুফের মতো বিভিন্ন দাবি করছেন তারা। শুধু ব্যাংক ঋণ নয়, রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে সরকারি উদ্যোগ, বিশ্ববাজারে নতুন বাজারসুবিধা তৈরির জন্যও সরকারি উদ্যোগ চেয়েছেন তারা।

এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সিনিয়র সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, রপ্তানি খাতে বিদ্যমান জটিলতাগুলো নিরসন জরুরি। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, মনিটরিং সেলের হয়রানি, বন্দর, কাস্টমসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সেবাপ্রাপ্তি সহজলভ্য হলে রপ্তানি কার্যক্রম গতিশীল হবে। তাতে ব্যবসা সহজীকরণের পাশাপাশি প্রতিযোগিতায় উত্কর্ষ সাধন হবে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বড় রপ্তানিকারক দেশ চীন থেকে ব্যবসা সরেছে, যা ভিয়েতনাম, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলো ধরতে পারলেও বাংলাদেশ সেই সুযোগ নিতে পারেনি। এর অন্যতম কারণ হতে পারে পণ্য বৈচিত্র্যকরণে বাংলাদেশের চাইতে আলোচ্য দেশগুলো এগিয়ে রয়েছে। তাই আগামী দিনগুলোর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে পণ্য বহুমুখীকরণে এখনি নজর দিতে হবে।

নগদ টাকার সরবরাহ বাড়াতে হবে :

বিদ্যমান পরিস্থিতি উত্তরণে উদ্যোক্তা, বিশেষজ্ঞ সবাই বলেছেন, বাজারে নগদ টাকার সরবরাহ বাড়ানোর কথা। যা অন্যান্য দেশগুলো করেছে। অর্থের জোগান বাড়াতে বড় অর্থনীতির প্রায় সবদেশই নীতিনির্ধারণী সুদ হার কমিয়েছে। খাদ্যে ভর্তুকিসহ নাগরিকদের নগদ অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শূন্যের কাছাকাছি নামিয়ে এনেছে নীতিনির্ধারণী সুদ হার। জার্মানিতে করোনার প্রভাবে দুর্বল হয়ে পড়া প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিনিয়োগ করছে রাষ্ট্র। প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার কিনে তহবিলের জোগান দিচ্ছে দেশটি। জামানতবিহীন ঋণ সুবিধার আওতা বাড়িয়েছে অনেক দেশ। ভারতে ঋণ পুনর্গঠনের আওতায় শুধু ব্যবসায়ীদেরই রাখা হয়নি, গাড়ি, বাড়িসহ ব্যক্তি পর্যায়ের ঋণেও পুনর্গঠনের সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। এমনকি গয়না জমা রেখে ঋণ প্রদানের সুবিধাও বাড়ানো হয়েছে দেশটিতে। অর্থনীতিতে গতি বাড়াতে এমন অনেক উদ্যোগ দেখা যায় বিভিন্ন দেশে। অনেক দেশে ব্যয় সাশ্রয়ের জন্য রাষ্ট্রীয় খরচ কমিয়ে এনেছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশও কৃচ্ছসাধনের জন্য কমগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে অর্থছাড় বন্ধ রেখেছে। সরকারি কর্মকর্তাদের ভ্রমণ এবং গাড়ি কেনায়ও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

তবে বিভিন্ন দেশে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে সাধারণ মানুষের ভোগ ব্যয়ের ওপর। করোনার সময়েও যাতে ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়—সেদিকে নজর রয়েছে সরকারের। কেননা, ভোগ ব্যয় বাড়লেই অর্থনীতিতে চাহিদা তৈরি হবে। এই চাহিদার মাধ্যমেই নতুন পণ্য উত্পাদিত হবে এবং অর্থনীতির চাকা ঘুরবে। সাধারণ মানুষের হাতে অর্থ না থাকলে সেই চাকা স্থবির হয়ে যাবে, সরকারের আয়ও কমে যাবে। বাংলাদেশে এ ধরনের উদ্যোগে ঘাটতি রয়েছে।

বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সহসভাপতি ইসহাকুল হোসেন সুইট বলেন, অন্যান্য দেশের মতো সরকারকেই অর্থের সংস্থান করতে হবে। ভোক্তা থেকে শুরু করে উত্পাদক পর্যন্ত সবার হাতে টাকা পৌঁছাতে হবে। বর্তমান প্রণোদনায় ক্ষুদ্র ও মাঝারিদের গুরুত্ব নেই। ব্যাংকগুলোকে বলা হলেও তারা ঋণ দিতে গিয়ে নানা বিষয় বিবেচনায় নিচ্ছে। কিন্তু সরকার যদি নিজেই অর্থ সংস্থান করে তা বিতরণের দায়িত্ব ব্যাংকগুলোকে দিত, তাহলে ব্যাংকগুলো গরিমসি করতে পারত না। এভাবে চলতে থাকলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের টিকে থাকার আশা দুরাশা মাত্র।

খাদ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে :

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, স্বাস্থ্য খাতের পাশাপাশি কৃষি খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে অর্থনীতি চাঙ্গা রাখার চেষ্টা করতে হবে। এবারের বাজেটেও স্বাস্থ্য ও কৃষি খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি মোকাবিলায় এই বরাদ্দ আরো বাড়ানোর আহ্বান করেন বিশ্লেষকেরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেছেন, এখন আমরা যে সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি সেই সংকট আমাদের একার নয়, গোটা পৃথিবীর। মানুষ বাঁচলে অর্থনীতি বাঁচবে। এজন্য স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ আরো বাড়াতে হবে এবং একইসঙ্গে গ্রামীণ অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখতে কৃষিখাতেও বরাদ্দ বাড়াতে হবে।

করোনা ভাইরাস কবে নিশ্চিহ্ন হবে—তা কেউ জানে না। এ অবস্থায় খাদ্য, সামাজিক নিরাপত্তা ও শিক্ষার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে। কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতির বিষয় ভাবতে হবে। বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা দেওয়াই এখন সবচেয়ে বড় কাজ। বিশ্ব জুড়েই এ সমস্যা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা করছে বিশ্ব খাদ্য সংস্থা। তাই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে খাদ্য সংগ্রহের চেয়ে অভ্যন্তরীণ উত্স থেকে খাদ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। গ্রামীণ অর্থনীতির দিকে সবচেয়ে বেশি নজর দিতে হবে। সেখানকার কৃষি উত্পাদন ও বিপণনের বিষয়ে সচেতন হতে হবে। এজন্য কৃষকদের যে সহায়তা দরকার তা দিতে হবে। বিশেষ করে প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকদের বিষয়টি দেখতে হবে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ক্ষেত্রে সরকারের যে প্রচেষ্টা তার সুফল যেন কৃষক পান, সে বিষয়টি যথাযথভাবে তদারকি করতে হবে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ফসল ফলানো ও গোলায় তোলার জন্য যেসব তথ্যগত ও কারিগরি সহায়তা দরকার সেগুলো যাতে কৃষক পায়। এজন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বড় ভূমিকা রাখতে পারে। কৃষিপণ্য উত্পাদনের পর তা গুদামজাত করার ক্ষেত্রে সরকারকে মনোযোগী হতে হবে। সার্বিকভাবে এখন জিডিপির প্রবৃদ্ধি কত শতাংশ হলো সেটার দিকে না তাকিয়ে খাদ্য নিরাপত্তা ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পিকেএসএফের চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, কোভিড-১৯ মহামারি পরিস্থিতিতে সঠিক পরিকল্পনা, কার্যক্রম গ্রহণ ও অর্থায়নের পাশাপাশি স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। টেকসই উন্নয়ন অর্জনের লক্ষ্যে অন্যান্য অভীষ্টের পাশাপাশি মানসম্পন্ন শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি গুরুত্বারোপ করতে হবে।

দুই বছর মেয়াদি পুনরুদ্ধার পরিকল্পনার পরামর্শ :

অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গত জুলাই থেকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে খসড়া প্রস্তুত ছিল। কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়া সত্ত্বেও এগুনো যায়নি। করোনা অনেক কিছু উলটাপালটা করে দেওয়ায় এর অভিঘাত মোকাবিলার জন্য পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় করোনা ইস্যুর সংযোজনের কথা ভাবছে সরকার। কেউ কেউ বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার পরিবর্তে দুই বছর মেয়াদি পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি।

পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম বলেন, করোনা ভাইরাসটি বিশ্ব অর্থনীতিকে নাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশেও এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। তাই আসন্ন অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় করোনার ইস্যু যুক্ত করতে হবে। এটির পুনর্বিন্যাস করতে হবে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার বদলে এখন দুই বছর মেয়াদি পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি সরকারি ব্যয়ে হ্রাস টানা, কর কমানো এবং মুদ্রাবিষয়ক নীতিকে সহজ করা, অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উত্স থেকে অর্থ সংগ্রহের উপায় বের করা প্রয়োজন। কমপক্ষে তিন বছরের জন্য এলডিসি থেকে উত্তরণের সময়কাল বিলম্বিত করা এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সময়কাল ২০৩০ থেকে ২০৩৫-এ নিয়ে যাওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক মহলে জোর প্রচেষ্টা চালানোর পক্ষে মত দেন তিনি।