বন্দরে আচমকা গাড়ির স্রোত

উন্নয়ন ডেস্ক –

সারি সারি গাড়ি। সংখ্যায় ৫ হাজার ৪৪১। নতুন বাজেটের শুল্ক্ক ছক গোপনে জেনে গাড়ি আমদানিকারকদের রীতিমতো হুড়োহুড়ি। কার আগে কে বন্দরে ভেড়াবে জাহাজ। নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে মোটরযান খাতের শুল্ক্ক অঙ্ক সবাই জেনেছে গত বৃহস্পতিবার। তবে বাজেট ঘোষণার আগেই এ খাতের শুল্ক্ক নথি গোপনে চলে যায় সংশ্নিষ্ট আমদানিকারকদের হাতে। গাড়ি ব্যবসায়ীরা আগেভাগে বাজেটের তথ্য জেনে ফেলায় বড় অঙ্কের রাজস্ব থেকে এবারও বঞ্চিত হতে যাচ্ছে সরকার।

নিয়ম অনুযায়ী, বাজেটের তথ্য গোপন থাকার কথা থাকলেও ঘোষণার আগেই প্রতিবার ফাঁস হয়ে যায় শুল্ক্ক তথ্য। কোন গাড়ির দাম বাজেটে কী পরিমাণ বাড়বে, গাড়ির ব্যাপারে নতুন কী নির্দেশনা আসছে, তা গোপনে জেনে নিয়ে রিকন্ডিশন্ড গাড়ি বন্দরে ভেড়ানোর প্রতিযোগিতা চলে বাজেটের ঠিক আগে আগে। বিলাস পণ্য নিরুৎসাহিত করতে এবারের বাজেটে ২ হাজার সিসি বা তদূর্ধ্ব গাড়িতে সম্পূরক শুল্ক্ক বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে সরকার। এই তথ্য আগে জেনে নিয়ে বাজেট ঘোষণার আগেই ছয় জাহাজে করে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার গাড়ি বন্দরে নামিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এর ফলে এসব গাড়িতে নতুন শুল্ক্ক হার আরোপ হবে না। বাড়তি শুল্ক্ক থেকে বাঁচতে আমদানিকারকরা তাড়াহুড়ো করে জাহাজ থেকে গাড়ি নামালেও সেগুলো এখনও পড়ে আছে বন্দরে। নতুন শুল্ক্ক হার যদি বাস্তবায়ন করা যেত, তবে এসব গাড়ি থেকে শতকোটি টাকার রাজস্ব পেত সরকার।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি চট্টগ্রাম চাপ্টারের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মদ সিকান্দার খান বলেন, ‘বাজেটের আগে তথ্য ফাঁস হয়ে গেলে সেটা সরকারের জন্য ক্ষতি। কোন পণ্যের দাম বাড়বে- ব্যবসায়ীরা যদি আগেই জেনে যায়, তাহলে তারা সেটি আগেভাগে এনে বেশি লাভের চিন্তা করে। গাড়ি আমদানিকারকদের কাছে তথ্যটা ফাঁস হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে আমাদের।’

চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুর আলম বলেন, ‘গোপন তথ্য ফাঁস হয়ে গেলে সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হবে। এই প্রবণতা দূর করা দরকার।’ তবে গাড়ি আমদানিকারক হাবিবুর রহমান বলেন, ‘গাড়ি এখন আর বিলাস পণ্য নয়। আবার বাজেটের আগে শুধু যে গাড়ির তথ্য ফাঁস হয়, তা নয়। অন্য অনেক পণ্যের শুল্ক্কহারও জানা যায় বাজেটের আগেই।’

বাজেটের আগে সর্বোচ্চ গাড়ি এসেছে এবার :বাজেটের আগে তথ্য ফাঁস হওয়ার এই প্রবণতা চলছে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে। তবে সবচেয়ে বেশি গাড়ি এসেছে এবারই। ছয় জাহাজে করে এবার গাড়ি এসেছে মোট ৫ হাজার ৪৪১টি। অথচ অর্থবছরের বাকি ৯ মাসে এসেছে ৬ হাজার ৮৩২টি। সর্বশেষ অর্থবছরে মোট ১২ হাজার ২৭৩টি গাড়ি আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে বাজেটের আগের দুই মাসে আমদানি হয়েছিল ১ হাজার ১৮২টি গাড়ি। ২০২০-২১ অর্থবছরেও অব্যাহত ছিল এমন আমদানির হিড়িক। সেবার মোট ১৩ হাজার ৪৪৯টি গাড়ি আমদানি হলেও বাজেটের আগের দুই মাসে আমদানি হয়েছে ৩ হাজার ৩৮৬টি গাড়ি। ২০১৯-২০ অর্থবছরেই শুধু ব্যতিক্রম ছিল এমন চিত্র। সেবার গাড়ি এসেছে অন্যবারের চেয়ে এক-চতুর্থাংশ। তবে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাজেটের আগের দুই মাসে গাড়ি এসেছে ১ হাজার ৬১০টি। এর আগের ২০১৭-১৮ অর্থবছরে মোট ২৩ হাজার ৭৫টি গাড়ি আমদানি হলেও বাজেটের আগের দুই মাসে এসেছে ৪ হাজার ৩১১টি।

গোপন তথ্য ফাঁস করে গাড়ি আনা হলো ছয় জাহাজে :এমভি লোটাস লিডার ও এমভি মালয়েশিয়ান স্টার জাহাজে করে গত ২৭ ও ২৯ এপ্রিল গাড়ি এসেছে ১ হাজার ৫১১টি। এর মধ্যে মোংলা বন্দরে নেমেছে ১ হাজার ৩১৩টি, আর চট্টগ্রাম বন্দরে ১৯৮টি। ১১ মে গাড়িভর্তি আরেকটি জাহাজ আসে বন্দরে। সেই জাহাজে গাড়ি আসে ১ হাজার ৭২৬টি। এর মধ্যে মোংলা বন্দরে নামে ৬৬৪টি গাড়ি, আর চট্টগ্রাম বন্দরে নামানো হয় ১ হাজার ৬২টি। এমভি মালয়েশিয়ান স্টার ও এমভি ভুটা ওয়ান জাহাজে করে গাড়ি আসে যথাক্রমে ২২ ও ২৩ মে। এ দুটি জাহাজে আসা ৯৮৬ ও ৩৮২টি গাড়ি নামানো হয় মোংলা বন্দরে। বাজেটের ঠিক পাঁচ দিন আগে ৪ জুন দেশে আসে গাড়িভর্তি আরেকটি জাহাজ। এবার গাড়ি আনা হয় মোট ১ হাজার ১৬৫টি। এর মধ্যে মোংলা বন্দরে ৩৮৭টি ও চট্টগ্রাম বন্দরে ৭৭৮টি গাড়ি নামানো হয়।

শুল্ক্ক বাড়ল কত :২ হাজার সিসির ওপর ইঞ্জিন ক্ষমতাসম্পন্ন মোটরযান আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক্কহার এবারের বাজেটে পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। মোটরযান ও স্টেশন ওয়াগন ক্যাটাগরির গাড়ি ২০০১ থেকে ৩ হাজার সিসি গাড়ির সম্পূরক শুল্ক্ক ছিল ২০০ শতাংশ। এখন এটি ২৫০ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ৩০০১ থেকে ৪ হাজার সিসির সম্পূরক শুল্ক্ক ৩৫০-এর স্থলে করা হয়েছে ৫০০ শতাংশ। বিযুক্ত (সিকেডি) মোটরযান, স্টেশন ওয়াগন ও জিপ গাড়ির সম্পূরক শুল্ক্ক হারও পাল্টানো হচ্ছে। এতদিন ২০০১ থেকে ৩ হাজার সিসি পর্যন্ত গাড়ির সম্পূরক শুল্ক্ক ছিল ১০০ শতাংশ, এখন সেটি ১৫০ শতাংশ। ৩০০১ থেকে ৪ হাজার সিসি পর্যন্ত গাড়ির সম্পূরক শুল্ক্ক ৩০০-এর স্থলে হয়েছে ৩৫০ শতাংশ। ৪ হাজার সিসির ঊর্ধ্বে সম্পূরক শুল্ক্ক ৩৫০-এর স্থলে হয়েছে ৫০০ শতাংশ। সম্পূর্ণ তৈরি হাইব্রিড মোটর গাড়ির ২০০১ থেকে ২৫০০ সিসি পর্যন্ত সম্পূরক শুল্ক্ক ছিল ৪৫ শতাংশ, এখন সেটি হয়েছে ৬০ শতাংশ। সিলিন্ডার ক্যাপাসিটির ২০০১ থেকে ৩ হাজার সিসি পর্যন্ত সম্পূরক শুল্ক্ক ৬০ শতাংশের স্থলে হয়েছে ১০০ শতাংশ। ৩০০১ থেকে ৪ হাজার সিসি পর্যন্ত ক্যাপাসিটি গাড়ি ১০০ শতাংশের স্থলে সম্পূরক শুল্ক্ক নির্ধারণ করা হয়েছে ১৫০ শতাংশ। ৪ হাজার সিসির ঊর্ধ্বে গাড়ি কিনতে হলে ৩০০ শতাংশের স্থলে সম্পূরক শুল্ক্ক দিতে হবে ৩৫০ শতাংশ। ২০০১ সিসি বা তদূর্ধ্ব মাইক্রোবাস আমদানিতে ৪৫ শতাংশের স্থলে সম্পূরক শুল্ক্ক নির্ধারণ করা হয়েছে ৬০ শতাংশ।