উন্নয়ন বার্তা ডেস্ক:
ভর্তির নীতিমালা অমান্য করে রাজধানীতে বাড়তি অর্থ আদায় করছে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো- এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে সরেজমিনে বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে এসব অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধান করা হয়।
প্রাক-প্রাথমিক থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী ভর্তিতে এই অনিয়ম হচ্ছে। দেখা গেছে, রাজধানীতে বাংলা ভার্সনের (সংস্করণ) স্কুলে ভর্তিতে সর্বোচ্চ আট হাজার টাকার পরিবর্তে আদায় করা হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা।
ইংরেজি ভার্সনে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকার পরিবর্তে ৩৫ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো।
সরকার নির্ধারিত ১১০ টাকার ভর্তি ফরম বাবদ নেওয়া হচ্ছে ২০০ থেকে ৫০০ টাকা। শিক্ষার্থী ভর্তিতে বাড়তি অর্থ আদায়ে কিছু কৌশল অবলম্বন করছে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ভর্তিতে সর্বোচ্চ যে অর্থ নির্ধারণ করা হয়েছে, তা কেবল সেশন ও ভর্তি ফির নামে নিচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো। এর বাইরে বেতন আলাদাভাবে নেওয়া হচ্ছে। স্টেশনারি ফি বাবদ নেওয়া হচ্ছে চার থেকে ছয় হাজার টাকা।
ইতিমধ্যে সারাদেশে এমন অনিয়মের অভিযোগের বিষয় তদন্তে আলাদাভাবে মনিটরিং টিম গঠন করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
পল্লবীতে পাঁচটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ভর্তি বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে—কসমো স্কুল, সাউথ পয়েন্ট, ক্যাম পাবলিক, প্যারাডাইস ইন্টারন্যাশনাল হাই স্কুল ও এম এ লতিফ মেমোরিয়াল ইনস্টিটিউট।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কসমো স্কুলের ইংরেজি ভার্সনে প্রথম শ্রেণিতে শিক্ষার্থী ভর্তিতে গুনতে হচ্ছে ৩৫ হাজার টাকা। এর মধ্যে আবেদন ফরম ফি ৫০০ টাকা, ভর্তি ফি ১০ হাজার টাকা, ছয় হাজার টাকা স্টেশনারি ফি এবং বাকি অর্থ সারা বছরের কার্যক্রমভিত্তিক পাঠদানের জন্য নেওয়া হয়। একই শ্রেণিতে ইংরেজি ভার্সনে ভর্তি হতে প্যারাডাইস স্কুলে নেওয়া হয় প্রায় ১৭ হাজার টাকা। এর মধ্যে আবেদন ফরমে নেয় ২০০ টাকা, ভর্তি ফি পাঁচ হাজার টাকা, সেশন ফি পাঁচ হাজার টাকা এবং স্টেশনারি বাবদ নেওয়া হয় চার হাজার ৪২০ টাকা। একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একই শ্রেণিতে বাংলা ভার্সনে আদায় করা হয় প্রায় ১২ হাজার টাকা। ভর্তি ও সেশন ফি তিন হাজার করে নেওয়া হলেও স্টেশনারি ফি নেওয়া হয় সাড়ে চার হাজার টাকা। এম এ লতিফে ইংরেজি ভার্সনে প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী ভর্তিতে নেওয়া হচ্ছে ১৮ হাজার টাকা, যেখানে ভর্তি ফরম ২০০ টাকা, সেশন ও ভর্তি ফি ১২ হাজার টাকা, স্টেশনারি ফি চার হাজার টাকা। বাংলা মাধ্যমে আদায় করা হচ্ছে ১০ হাজার টাকা, যার মধ্যে স্টেশনারি ফি তিন হাজার টাকা।
অতিরিক্ত ফি আদায়ের বিষয়ে কসমো স্কুলের অধ্যক্ষ এস এম মাহবুব-উল আলম মিডিয়াকে বলেন, ‘নীতিমালা অনুযায়ী আমরা ভর্তি ফি নিচ্ছি প্রায় ১০ হাজার টাকা। প্রতিষ্ঠানটিতে কার্যক্রমভিত্তিক পাঠদানে শিখন উপকরণ এবং আউটিংয়ে অনেক অর্থ ব্যয় হয়। সে তুলনায় শিক্ষার্থী ভর্তিতে ৩৫ হাজার টাকা অনেক কম। ’ প্রতিষ্ঠানটিতে উন্নতমানের পাঠদানব্যবস্থা থাকায় অন্য বিদ্যালয়ের সঙ্গে খরচের তুলনার সুযোগ নেই বলে জানান তিনি।
নীতিমালা অমান্য করে বাড়তি ফি আদায়ের বিষয়ে অধ্যক্ষ বলেন, ‘তাহলে সরকার এসে আমাদের অ্যাক্টিভিটিজ ফি দেবে। সরকার আসুক না আমাদের কাছে, আমরা বলব আমাদের কাজ দেখেন। কাজ দেখে যাচাই করেন, এই অর্থ দিয়ে পাঠদান সম্ভব কি না। ’
এম এ লতিফ মেমেরারিয়াল ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ এল এম কামরুজ্জামান বলেন, ‘আগে ভর্তি ফি ১০ হাজার টাকা নির্ধারিত ছিল। অনেক অভিভাবক টাকা কমানোর অনুরোধ জানান। এ কারণে সামান্য বাড়িয়ে ফি নির্ধারণ করা হয়েছে, যাতে কমালেও ওই টাকাটা থাকে। আবার ভর্তি ফি এখন নেওয়া হচ্ছে না, শিক্ষার্থীরা তা পরে দিতে পারবে। ’
প্যারাডাইস ইন্টারন্যাশনাল হাই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ মো. শহীদুর রহমান বলেন, ‘অনেক আগে থেকেই আমাদের (ভর্তি ফি) এ রকম। এমপিওভুক্ত না হওয়ায় আমাদের কিছুটা বেশি নিতে হয়। গতকাল থানা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয়েছে বাড়তি ফি নেওয়ার বিষয়ে। উনার থেকে আমি এটি অ্যাপ্রুভ (অনুমোদন) করিয়েছি। ’ তবে এই অনুমোদনের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন পল্লবী থানা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ফারজানা শারমিন। তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে সহকারী মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে। স্কুলগুলোতে ভর্তির বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হচ্ছিল, আমি তখন পাশেই ছিলাম। তবে নীতিমালার বাইরে অর্থ আদায়ে তাঁকে নিষেধ করা হয়েছে। বাড়তি ফি আদায়ে এর মধ্যে তিন-চারটি প্রতিষ্ঠানের অভিযোগ পেয়েছি। আগামীকাল ২৩ ডিসেম্বর অভিযোগ ওঠা স্কুলগুলো থেকে কাগজপত্র সংগ্রহ করা হবে। ’
বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি ফি বেশি নেওয়ার অভিযোগ তদন্তে চারটি মনিটরিং টিম গঠন করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ২২ ডিসেম্বর বুধবার থেকে এসব মনিটরিং টিম কাজ শুরু করেছে।
মাউশির ঢাকা মহানগরের ১৬টি, বিভাগীয় আটটি এবং বিভাগীয় সদর জেলার ৫৫টি মনিটরিং কমিটি সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভর্তি বিষয়ক ফির সব তথ্য নিয়ে মাউশিতে প্রতিবেদন পাঠাবে। এর বাইরেও সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত করবেন মাউশির মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা।
মাউশির মাধ্যমিক বিভাগের পরিচালক মো. বেলাল হোসাইন বলেন, ‘শিক্ষা অধিদপ্তরের আওতায় যতটুকু ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব, মহাপরিচালকের নির্দেশনায় আমরা সেই ব্যবস্থা নেব। মহাপরিচালকের এখতিয়ারের বাইরে কিছু থাকলে তা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। ’
ভর্তি নীতিমালা-২০২৩-এ বলা হয়, শিক্ষার্থী ভর্তিতে মাসিক বেতন, সেশন চার্জ, উন্নয়ন ফিসহ বাংলা মাধ্যমে সর্বোচ্চ আট হাজার টাকা নেওয়া যাবে। ইংরেজি মাধ্যমে নেওয়া যাবে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা। উন্নয়ন ফি তিন হাজার টাকার বেশি আদায় করা যাবে না। ঢাকা মেট্রোপলিটনে আংশিক এমপিওভুক্ত বা এমপিওবহির্ভূত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে এই নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে।