বিশেষ প্রতিনিধি:
বাংলাদেশে জিডিপি বিশ্বে প্রশংসিত হলেও রাজস্ব আদায়ে মন্তর গতি চলছেই। বিদায় অর্থবছরেও রাজস্ব ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড(এনবিআর) সূত্রে জানা যায় বিদায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরের দশ মাসে রাজস্ব আদায় হয়েছে ১ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। আদায়ের শীর্ষে আছে ভ্যাট আর সর্বনি¤েœ আয়কর। আদায়ে হার ১২ দশমিক ৮৭ শতাংশ। এনবিআরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, দুই মাসে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায় আদায় সম্ভব নয়। যেহেতু মোট আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধাণ করা আছে (সংশোধিত) ৩ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। প্রতিবছরই মোটা অংকের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। আর ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীন খাত থেকে ঋণ ধরা হয়েছে ১ লাখ ৯ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা আর বৈদেশিক উৎস থেকে প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ৮০ হাজার কোটি টাকার বেশি। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় না হওয়ায় সরকারের ঋণের বোঝা বাড়ছে। ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২১ সালে জানুয়ারি পর্যন্ত ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নিয়েছে ৪৯ হাজার ১০৯ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ঋণ নিয়েছিল ৩০ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা। নানা জঠিল ও কঠিন শর্তের কারণে বৈদেশিক ঋণ সহায়তা কমে যাওয়ায় সরকার অভ্যন্তরীণ ঋণ নির্ভর হয়ে পড়ছে। অবশ্য এটা শুরু হয়েছে বিগত চারদলীয় জোট সরকার আমলেই। ঋণের সুদ মেটাতেই মোটা অংকের টাকা চলে যাচ্ছে। এতে উন্নয়ন কাজের ব্যয় মেটানো কঠিন হয়ে পড়ছে। রাজস্ব আদায় বাড়লে ঋণের বোঝা কমতো। কিন্তু কাংখিত পরিমাণ রাজস্ব আদায় হচ্ছে না। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ব্যাপক হচ্ছে। স্বল্পোন্নত থেকে বাংলাদেশে উন্নয়নশীল দেশে উত্তোরণ ঘটেছে। গত একদশকে দেশের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। বাড়ছে মানুষের আয়, বাড়ি-গাড়ি মালিকের সংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে মাথাপিছু আয়। সেই সাথে বাড়ছে ক্রয় ক্ষমতাও। অর্থনীতির সূচকে বাংলাদেশ পাশ্ববর্তী থেকে ভারতের সহ অন্যান্য দেশের চেয়ে এগিয়ে। বাংলাদেশের জিডিপি এখন গোটা বিশ্বে প্রসংশিত। এতো অগ্রগতি থাকার পরও কর আদায়ের চিত্রটা হতাশাজনক। কিন্তু কর দাতার সংখ্যা বাড়ছে না। সক্ষম ব্যক্তিরা সরকারকে রাজস্ব দিচ্ছে না। অর্থমন্ত্রী চলতি অর্থবছরের বাজেট বক্তব্যে বলেছিলেন, দেশে চার কোটি নাগরিক মধ্যম আয়ের অন্তর্ভুক্ত হলেও কর দেন মাত্র ২২ লাখ লোক। করের আওতা বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে বার বার। এ জন্য রাজধানী থেকে উপজেলা পর্যন্ত করদাতা শনাক্ত ছাড়াও অফিস স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। চলতি অর্থবছরের মধ্যে এক কোটি লোককে নতুন করে করের আওতায় আনতে উদ্যোগ নেয়া হলেও তেমন কোন অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। বিশেজ্ঞরা বলছেন, রাজস্ব আদায় বাড়ানো না গেলে সরকারেরে ঋণে বোঝা বাড়বেই। এসমম্পর্কে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে সাবেক কমিশনার ড. এস এম জাহাঙ্গীর আলম বলেন, কর আদায় বাড়াতে হলে প্রথমেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে ঢেলে সাজাতে হবে, প্রয়োজন জনবল বাড়তে হবে, অটোমেশন করতে হবে কর বিভাগকে। রাজস্ব আহরনের বেলায়ও কিছু প্রতিবন্ধকতা আছে যা দুর করা দরকার। যেমন, দক্ষ এবং মেধাবী কর কমিশনারদের অযথা হয়রানী ও জুনিয়র কমিশনারদের অপতৎপড়তা লক্ষ্য করা যাচ্ছে যা দুর করতে হবে। অভিজ্ঞ ও মেধাবী কর্মকর্তাদের পাশ কাটিয়ে আকর্ষনীয় স্থানে জুনিয়রদের পদস্থ করায় রাজস্ব প্রাপ্তিতে বিঘœ ঘটাচ্ছে। কর আহরণের বেষ্টনী প্রক্রিয়ায় ধীরগতি ও রাজস্ব আহরনে তৎপড়তা তেমন নেই যা বাড়ানোর প্রয়োজন। কাষ্টমস এবং আয়কর বিভাগের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের মাঝে জবাবদিহিতা ও পর্যবেক্ষনের অভাব আছে তা দূর করতে হবে। সিনিয়রদের ডিঙ্গিয়ে জুনিয়র কমিশনাদের অপতৎপরতার বিষয়টি প্রতিনজর দিতে হবে। বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশী সংস্থার কার্যক্রম উপেক্ষা করে রাজস্ব আহরণে (ভ্যাট ও আয়কর) অপতৎপড়তা ও দৃষ্টিকটুর। সুনির্দিষ্ট তথ্য সম্বলিত অভিযোগ থাকা সত্বেও রাজস্ব আহরনের গতিবিধি মন্থর, যা দেশের উন্নয়নের গতিধারাকে ব্যাহত করছে। এনবিআর-এর রেকর্ড অনুযায়ি গত ৫০ বছরে উল্লেখিত কার্যক্রমের কোন নীতিগত তথ্য বা প্রমানাদি নেই বিধায় কর ও শুল্ক প্রশাসন খুবই নাজুক। এসব বিষয়ের কারনেও রাজস্ব আদায়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। এখানে উল্লেখ্য, করের আওতা বাড়লেও সামর্থ্যবান করদাতার সংখ্যা বাড়েনি। কর বান্ধব পরিবেশও তেমন বাড়েনি। জিডিপি’র বিচারে বছরে কর আদায় হওয়া উচিত কমপক্ষে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা। অথচ আদায় হচ্ছে অনেক কম। আমি মনে করি যোগ্য সবাইকে করের আওতায় আনতে পারলে আয়কর তিন গুণ বাড়ানোর সুযোগ আছে। দেশে বর্তমানে ৭০ শতাংশ মানুষের করযোগ্য আয় আছে। যোগ্য সবাইকে করের আওতায় আনতে পারলে কর আদায় অনেক বেড়ে যাবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড(এনবিআর) যে পরিমাণ রাজস্ব আদায় করে, তার মধ্যে আয়করের অংশ বর্তমানে প্রায় ৩৬ শতাংশের কাছাকাছি। সবাইকে করের আওতায় আনতে পারলে তা ৫০ শতাংশে উন্নীত করা সম্ভব। কর আদায় বাড়াতে নাগরিক সচেতনতা বাড়ানো দরকার। যথাযোথ ভাবে পরোক্ষ কর অর্থাৎ ভ্যাট আদায়, একটি নির্দিষ্ট সীমার ওপরের লেনদেনে অনলাইন ব্যবস্থা চালু বা ব্যাংকিং মাধ্যমে লেনদেন বাড়ানো, সরকারের সংস্থাগুলো যে ভ্যাট আদায় করে সেগুলো এনবিআর’র হিসাবে সময়মত জমা, উন্নয়ন প্রকল্প ও অন্যান্য যেসব ক্ষেত্রে কর অব্যহতি রয়েছে সেগুলো বন্ধ করা এবং রাজস্ব সংক্রান্ত মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা গেলে জিডিপি’র কর জিডিপি’ কমপক্ষে ৫ শতাংশ বাড়বে। তবে এটা ঠিক যে রাজস্ব খাতের সংস্কার কর্মসূচিকে যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। চিহ্নত করতে হবে কি কি কারণে রাজস্ব বাড়ছে না। যারা ভ্যাট ফাঁকি দিচ্ছে বা ভ্যাটের আওতার বাইরে রয়েছে তাদের থেকে ভ্যাট আদায় নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। এছাড়া যে সকল ব্যক্তি, গোষ্ঠি ও প্রকল্পে কর অব্যহতি দিচ্ছে তা বন্ধ করা জরুরি। রাজস্ব আহরণের পাশাপাশি অপচয়, অনিয়ম কমিয়ে স্বচ্ছতা বাড়াতে হবে। সরকারের সেবা দপ্তরগুলো যেমন বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, বিটিআরসি, বিআরটিএ সবগুলো জনগণের কাছ থেকে ভ্যাটসহ যেসব অন্যান্য কর আদায় করে এনবিআরকে দিচ্ছে না, সেগুলো দ্রুত জমার ব্যবস্থা নিতে হবে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে যে, একটা নির্দিষ্ট সীমার বেশি অংকের লেনদেন যদি অনলাইন বা ব্যাংকিং ব্যবস্থার আওতায় আনা যায়, তাহলে সরকার দেখতে পারবে কে কোথায় কি কাজে কত টাকা ব্যয় করছে। তখন যারা আয়কর বিবরনী দিচ্ছেন না, তাদের ব্যয় ধরে বলা যে, আপনার এধরনের ব্যয় করার সামর্থ থাকার পরও কেন আয়কর বিবরণী দিচ্ছেন না। এতে স্বচ্ছতা বাড়ার পাশাপাশি করের আওতা বাড়বে। ভ্যাট সংগ্রহের বেলাও একই ধরনের উদ্যোগ থাকা প্রয়োজন। একটা বিষয় আমরা ভাল করেই জানি যে, দেশের সাধারণ করদতারাই ঋণ শোধ ও উন্নয়নের মূল উৎস হিসেবে কাজ করছেন। বার বার বলা হলেও আয়কর এখনো কর আদায়ের প্রধান উৎস নয়। ভ্যাটের মাধ্যমেই ব্যয় নির্বাহ করতে হচ্ছে। এই আয়-নিরপেক্ষ পরোক্ষ করের বোঝা সবটাই সাধারণ জনগণের কাঁদে চেপে বসে। নি¤œবিত্ত ও মধ্যবিত্ত জনগণের ওপর করের ভার বর্তাচ্ছে। বিপরীত দিকে উচ্চবিত্তদের কর পরিহার ও ফাঁকি দেয়াটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিশেষে যা বলতে চাই তা হলো-বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকারের ঋণের বোঝা বেড়েই চলছে। এই বোঝা কমাতে হলে রাজস্ব আদায়ের গতি বাড়ানোর বিকল্প নেই। বর্তমানে রাষ্ট্রের উন্নয়নের গতিধারা তরান্বিত করতে হলে অধিক মাত্রায় রাজস্ব আহরনের কোন বিকল্প নেই।