লালবাগে অগ্নিকাণ্ড: আরেকটি বিপর্যয়ের জন্য অপেক্ষা?

উন্নয়ন ডেস্ক –

পুরান ঢাকার লালবাগের শহীদনগর এলাকায় একটি প্লাস্টিক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ক্ষেত্রে মন্দের ভালো যে, কেউ হতাহত হয়নি। বৃহস্পতিবার বাংলা নববর্ষ এবং পরদিন সাপ্তাহিক ছুটি থাকার কারণে সম্ভবত শুক্রবারের এই দুর্ঘটনা ব্যাপক ও প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারেনি। দিনের বেলায় আগুন লাগায় খানিকটা ‘সুবিধা’ হয়েছে এই যে; কারখানা ও এর আশপাশে কর্মরতরা দ্রুত সরে পড়তে পেরেছেন। অগ্নিনির্বাপক বাহিনীও দ্রুত অকুস্থলে উপস্থিত হতে পেরেছে। কারখানাটি ‘টিনশেড’ হওয়ার কারণেও অগ্নিকাণ্ড ও পরবর্তী নির্বাপণ পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠেনি। অতীতে এই রাজধানীতে আমরা অনেকবারই দেখেছি, রাতের বেলা বিভিন্ন বহুতল কারখানায় অগ্নিকাণ্ড কীভাবে সর্বগ্রাসী ও প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছে। গত বছরের নভেম্বরে পুরান ঢাকারই সোয়ারীঘাট এলাকায় একটি রাসায়নিক কারাখায় অগ্নিকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে আনতে অগ্নিনির্বাপক বাহিনীর ১৪ ঘণ্টা লেগেছিল। ওই অঘটনে নিহত পাঁচ শ্রমিকের দেহ এতটা পুড়ে গিয়েছিল যে, প্রাথমিকভাবে তাদের শনাক্তই করা যায়নি। অবশ্য এবারের ক্ষয়ক্ষতি ‘নিয়ন্ত্রণে’ থাকায় আত্মতুষ্টিতে ভোগার অবকাশ নেই। পুরান ঢাকা অনেক ট্র্যাজেডির সাক্ষী হয়ে আছে। ঘিঞ্জি ও জনবহুল এই এলাকায় বৃহত্তর বিপর্যয়ের ঝুঁকি সব সময়ই রয়ে যাচ্ছে। আবাসিক ও বাণিজ্যিক ওই এলাকা থেকে রাসায়নিক ও দাহ্য পদার্থের কারখানা, গুদাম ও ব্যবসায়িক কার্যক্রম সরিয়ে না নিলে যে কোনো সময় জনবহুল এলাকা জতুগৃহে পরিণত হতে পারে।

দুর্ভাগ্য ও উদ্বেগের বিষয়- প্রায় নিয়মিত বিরতিতে একের পর এক অগ্নিকাণ্ড ঘটলেও পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক কারখানা ও গুদামগুলো সরছে না। ভুলে যাওয়া কঠিন যে, শহীদনগর থেকে সামান্য দূরত্বেই অবস্থিত ‘নিমতলী ট্র্যাজেডি’র অকুস্থল। ২০১০ সালে ভয়াবহ ওই অগ্নিকাণ্ডের পরই পুরান ঢাকার সব রাসায়নিক কারখানা ও দাহ্য পদার্থের গুদাম সরিয়ে নেওয়ার অঙ্গীকার করেছিল সংশ্নিষ্ট বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ। এক যুগ পার হয়ে গেলেও ওই প্রতিশ্রুতির পূর্ণ বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। আমরা জানি, বিলম্বে হলেও বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন-বিসিক মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখানে একটি কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করেছিল। কিন্তু সমকালেই প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ওই প্রকল্পে কেবল মাটি ভরাটের কাজ চলছে। আমাদের প্রশ্ন, মাটি ভরাটের কাজ শুরু হতেই যদি এক যুগ পার হয়ে যায়, তাহলে মূল প্রকল্প বাস্তবায়নে কত যুগ প্রয়োজন হবে?

কর্তৃপক্ষের গদাইলশকরি চাল বিবেচনায় এই প্রশ্ন অমূলক হতে পারে না- পৃথক রাসায়নিক পল্লি পেতে হলে আর কত প্রাণ দিতে হবে? আমরা মনে করি, নিমতলী অগ্নিকাণ্ডের পরই যদি গুদাম ও কারখানাগুলো সরিয়ে নেওয়া হতো; তাহলে ২০১৯ সালে চকবাজারে, গত বছর এপ্রিলে আরমানিটোলায় এবং নভেম্বরে সোয়ারীঘাটে এত জীবন ও সম্পদহানি হতো না। এটা ঠিক, শুক্রবারের অগ্নিকাণ্ডে শহীদনগরে প্রাণহানি ঘটেনি। কিন্তু মনে রাখতে হবে- কারখানা পুড়ে যাওয়ার কারণে কেবল মালিক সর্বস্বান্ত হননি; নিম্নবিত্ত শ্রমিকরাও কর্মহীন হয়েছেন। দুই বছর করোনা পরিস্থিতিতে অনেক কর্মহীনতা কাটিয়ে যখন সবাই ঘুরে দাঁড়াতে চাইছে, তখনই এ ধাক্কা সামলানো সহজ নয়। কেবল অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি সামলানো নয়; সামনের দিনগুলোতে যে আরও অগ্নিকাণ্ড ঘটবে না এবং সেখানে সম্পদের পাশাপাশি প্রাণও হারাতে হবে না- এ নিশ্চয়তা কে দেবে?

আমরা মনে করি, বিলম্বে হলেও খতিয়ে দেখার সময় এসেছে- কাদের ঔদাসীন্য ও অবহেলায় পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক ও প্লাস্টিক কারখানা, গুদাম ও ব্যবসাকেন্দ্র সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ বাস্তবায়ন ঝুলে যায়? স্বীকার করতে হবে- রাসায়নিক কারখানা ও দাহ্য পদার্থের গুদাম পুরান ঢাকার জন্য এক ‘বাণিজ্যিক বাস্তবতা’। এ ধরনের ব্যবসার জন্য ভবন ভাড়া দিলেও মেলে সবচেয়ে বেশি দাম। কিন্তু ক্ষুদ্রতর ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবিশেষের স্বার্থে বৃহত্তর নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ে এভাবে একটি নগর চলতে পারে না। কমবেশি দুই কোটি অধিবাসীর এই নগরের নিরাপত্তা বিধান সহজ নয়। কিন্তু বাণিজ্যিক ও আবাসিক এলাকা আলাদা করতে পারলেই অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি বহুলাংশে এড়ানো সম্ভব। সেই জরুরি কাজ সম্পন্ন হোক আরেকটি বিপর্যয়ের জন্য অপেক্ষা না করেই।