হোটেল দখল করেন যেভাবে সাহেদ

উন্নয়ন ডেস্ক –

উত্তরা ৬ নম্বর সেক্টরে হোটেল মিলিনার মালিক আনোয়ার হোসেন গতকাল সোমবার মামলা করেছেন রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. সাহেদ ওরফে সাহেদ করিমের বিরুদ্ধে। আগের দিন তিনি অভিযোগ জমা দেন র‌্যাব, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিভাগের কাছে। অংশীদারির ভিত্তিতে হোটেল পরিচালনার কথা বলে গত বছরের নভেম্বরে সাহেদ করিম হোটেলটি দখল করে নেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে চুক্তিতে রিজেন্টের উত্তরা ও মিরপুর শাখা ছাড়াও করোনা মোকাবিলায় হোটেল মিলিনা দেওয়ার কথা বলেছিলেন সাহেদ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যবহারের জন্য নির্ধারিত হোটেলের যে তালিকা দেয়, তাতে হোটেল মিলিনার নাম ছিল। তবে রিজেন্ট হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, হোটেল মিলিনা থেকে খাবার এলেও তাঁদের সেখানে থাকার ব্যবস্থা ছিল না।

মিলিনার মালিক আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে গতকাল কথা হয় উত্তরায় তাঁর বাসায়। এই হোটেলের দখল নিয়ে সাহেদ তিনটি মামলা করেন আনোয়ার হোসেনের নামে। সবশেষ হোটেলটিকে নিজের সম্পদ দেখিয়ে সাড়ে আট কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার জন্য কাগজপত্র প্রস্তুত করেছিলেন সাহেদ। এর মধ্যেই ৬ জুলাই র‌্যাব উত্তরার রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযান চালায়। এরপর ১৫ জুলাই সাতক্ষীরা সীমান্ত থেকে র‌্যাব তাঁকে গ্রেপ্তার করে।

আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, একটা বড় সময় তিনি জাপানে কাটিয়েছেন। দেশে ফিরে উত্তরা ৬ নম্বর সেক্টরের ৯ নম্বর সড়কে জমি কিনে আটতলা ভবন করেন। ২০১১ সালে চালু করেন হোটেল মিলিনা। ব্যবসা পরিচালনার জন্য তিনি বিনিয়োগকারী খুঁজছিলেন। গত বছর নভেম্বরের দিকে কাজী সাইফুল বারী নামের এক ব্যক্তি নিজেকে রিজেন্ট গ্রুপের প্রতিনিধি পরিচয় দিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। তিনি বলেছিলেন, তাঁদের উড়োজাহাজের ব্যবসা আছে। অতিথি, পাইলট, কেবিন ক্রুরা সেখানে উঠবেন, হোটেল জমজমাট চলবে।

আনোয়ার হোসেন বিষয়টি নিয়ে ভাবার জন্য সময় চান। কিন্তু সাহেদ পক্ষের তাড়া ছিল। তাঁরা ২১ নভেম্বর আনোয়ার হোসেনকে রিজেন্ট সদর দপ্তরে যাওয়ার অনুরোধ করেন। আনোয়ার দাবি করেন, প্রতি মাসে হোটেল মিলিনা থেকে ৮ লাখ টাকা ভাড়া ও প্রতি মাসে লাভের ৬০ শতাংশ দিতে হবে। রিজেন্ট গ্রুপের কর্মীরা তাঁকে বলেন, ভাড়া সাড়ে ৭ লাখ টাকা ও লাভের ৫৫ শতাংশ দেওয়া হবে। সাহেদের কক্ষে ঢোকার আগে ওই কর্মীরা আনোয়ারকে এই শর্তে রাজি হতে বলেন।

ওই দিনের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে আনোয়ার হোসেন বলেন, বাইরে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর সাহেদের ঘরে ঢোকার অনুমতি পান তিনি। আধশোয়া অবস্থায় সাহেদ তাঁর কর্মীদের চুক্তিতে কী আছে, পড়ে শোনাতে বলেন। এ সময় সাহেদ বলেন, তাঁর ভীষণ তাড়া আছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক আমলা বিদেশ থেকে আসছেন। তাঁকে স্বাগত জানাতে তাঁকে বিমানবন্দরে যেতে হবে। বেশ তাড়াহুড়ার মধ্যে আনোয়ার হোসেন সেদিনই চুক্তিতে সই করেন। ওই দিন রাত ১১টায় মোহনা টেলিভিশনে টক শো করে সাহেদ তাঁর দলবল নিয়ে মিলিনায় যান। সেদিনই হোটেলের সব হিসাব-নিকাশ বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য তাগিদ দেন। পরদিনই হোটেল দখলে নেন সাহেদ।

কিছুদিনের মধ্যেই আনোয়ার বুঝতে পারেন, তিনি বিপদে পড়েছেন। বিমানের পাইলট, ক্রু বা যাত্রী কেউই আসছেন না। আনোয়ার সাহেদের সঙ্গে বসতে চান। গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর তিনি জানতে পারেন, তাঁর নামে আদালতে তিনটি মামলা হয়েছে। সাহেদের লোকজন মুঠোফোনে তাঁকে পরোয়ানা জারির কাগজও পাঠান। বেঁচে থাকতে চাইলে তাঁকে চুপ করে থাকতে বলা হয়।

আনোয়ার মিডিয়াকে বলেন, ‌এখন সাহেদের বিরুদ্ধে যে যে ধরনের প্রতারণার মামলা হয়েছে, সাহেদ তাঁর বিরুদ্ধে ওই একই ধরনের অভিযোগে আদালতে মামলা করেন। মামলা করতে না করতেই পরোয়ানা জারি হলো কী করে, খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, আইন মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার হাত আছে এতে। পরে তিনি হাইকোর্ট থেকে জামিন নেন। কিন্তু হোটেলে আর ঢুকতে পারেননি।

এক প্রশ্নের জবাবে আনোয়ার জানান, চুক্তি সই হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ভাড়া বাবদ জমা হওয়া ৬০ লাখ টাকার এক টাকাও পাননি তিনি। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাসের ৯ লাখ টাকার বিল। রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযানের পর আনোয়ার হোটেলে গিয়ে অনেক কিছুই খুঁজে পাননি। তাঁর দাবি, অন্তত ৪২ লাখ টাকার জিনিসপত্র সাহেদ সরিয়ে ফেলেছেন।

বিদেশে অর্থ পাচার

ট্রান্স গ্লোবালনেক্সাস নামে একটি প্রতিষ্ঠান থেকে এ মেহতা নামের এক ব্যক্তি র‌্যাবকে জানিয়েছেন, সাহেদ বিদেশে টাকা পাচার করেছেন। যুক্তরাজ্যভিত্তিক ওই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে প্রথম আলো ই-মেইলে যোগাযোগ করে। এ মেহতা গতকাল ফিরতি মেইলে মিডিয়াকে বলেন, সাহেদ জানিয়েছিলেন, তিনি দেশের ভেতর সম্পদ রাখতে চান না। প্রথমে তিনি ভারতে তাঁর আত্মীয়ের নামে সম্পদ কেনেন। তিনি সেখানে আধার কার্ড (পরিচয়পত্র) করারও চেষ্টা করছিলেন।

এ মেহতা মিডিয়াকে আরও বলেন, সাহেদ তাঁকে বলেছিলেন, তিনি মধ্যস্থতা করে টাকা আয় করেন। বাংলাদেশে প্রভাবশালীদের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটিয়ে সম্পদের মালিক হওয়ার নজির আছে বলেই তিনি সাহেদের কথা বিশ্বাস করেছিলেন। তিনি বলেন, ২০১২ সাল থেকে অল্প অল্প করে সাহেদ টাকা পাচার করছিলেন। ২০১৬ সালের পর টাকা পাচারের পরিমাণ বাড়ে। তিনি বিনিয়োগকারী কোটায় ইউরোপের একটি দেশে নাগরিকত্ব পাওয়ার চেষ্টা করেন। তাঁর দাবি, সাহেদ ৬০ লাখ মার্কিন ডলার পর্যন্ত পাচার করেছেন।

জাতীয় পরিচয়পত্রের কার্যকারিতা স্থগিত

মো. সাহেদ ওরফে সাহেদ করিমের জাতীয় পরিচয়পত্রের কার্যকারিতা সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে নির্বাচন কমিশন। সাহেদ জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধনের সময় কোনো ভুল তথ্য বা মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন কি না বা নাম পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কোনো অসাধু উদ্দেশ্য ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

এদিকে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ মিডিয়াকে বলেন, তাঁদের কাছে আরও ১০টি অভিযোগ জমা পড়েছে। তাঁরা এখন যে কেউ ফোন করলেই আর অভিযোগ নিচ্ছেন না। যে ধরনের অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে, শুধু সেগুলোই নিচ্ছেন।